‘ঢিংপাড়ার আশি পেরুনো মনসুর আলী, পাঘাতগ্রস্ত ফুলবালা, যুবতী কমলা, মধ্যবয়সী সামিনা। এদের কেউ গত এক মাস ধরে একবেলা পেট পুরে খেতে পায়নি। চোখের সামনে বৃদ্ধ বাপটাকে এভাবে না খেয়ে মরতে হবে ভেবে কষ্ট- ক্রোধে কেঁদে ফেললো খতিবুলা...’ সংবাদটা এভাবেই লিখেছিলেন আজকের কাগজের ডিমলা প্রতিনিধি এম এ বারী।
নিলফামারীর চাপড়াসবমজানী ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নের বড় ঢিংপাড়া, ছোট ঢিংপাড়া, চেয়ারম্যানপাড়া, গ্রামগুলোতে একশ ভাগ মানুষ বেকার। কর্মহীন। সারা বছরই তাদের যুদ্ধ করে জীবন বাঁচিয়ে রাখতে হয়। সেই যুদ্ধে কোনো আত্মঘাতী বোমা নেই। একে-৪৭ নেই, কালাশনিকভ নেই। আছে ঠাণ্ডা যুদ্ধের ভয়াবহতা। সাদা সাদা ফোলা ফোলা নরম এক ধরনের বস্তু যার নাম ভাত। সেই ভাতের প্রাপ্যতা নয়, ভাতের জোগাড় নিয়ে এই যুদ্ধ। সারা বছরের টানাটানির সংসারে আশ্বিন-কার্তিক এলেই আর চলে না। সময় যেন থমকে দাঁড়ায়। সূর্যটা সেই যে ওঠে, গনগনে আগুনের মতো আর যেন ডোবে না। সে যতো তাপ ছড়ায়, যতো ঘাস পুড়িয়ে দেয়, যতো পাতা জলশূন্য করে তারচেয়ে ঢের দহনে জ্বলতে তাকে পেটের আগুন। দাউ দাউ করে জ্বলে। নিলফামারী না খেতে পেয়ে মরার জন্য বিখ্যাত নয়। এ বেলায় এগিয়ে কুড়িগ্রাম।
গেলো বছর এই সময়ে কুড়িগ্রামের এক প্রত্যন্ত গ্রামে খেতে না পেয়ে মরে গেয়েছিল সোহাগী বালা। নিউজপ্রিন্টের ওপর তোবড়ানো গাল সোহাগী বালার ছবিটা ছাপা হয়েছিল ভোরের কাগজে। ওই চবিটা মুখ বাঁকা করে ব্যঙ্গ করেছিল আমাদের সভ্যতাকে। আমাদের জাঁকজৌলুসকে। ওই ছবিটা ছাপা হওয়ার পরও আমরা আদিম যুগের গুহা মানবের মতো বেহায়া হয়ে কাড়ি কাড়ি ভাত গিলেছিলাম। ভাতগুলো সুস্বাদু করতে নানাবিধ ব্যাঞ্জন মিশিয়েছিলাম। অতি ভোজনের পর কার্বোনেটেড পানীয় পান করেছিলাম। ঢাকার কোটি খানেক মানুষের জীবনে কোনোই ব্যতিক্রম হয়নি সোহাগী বালা উপাখ্যান।
এক বছর বাদে আবারো সোহাগী বালাদের নিয়ে লিখতে গিয়ে মনে পড়ছে, ওর পরে আমরা রাশি রাশি নিউজপ্রিন্ট খরচ করেছি রাজনীতির নোংরা ঘাঁটতে ঘাঁটতে। আত্মা-টাত্মা কোথায় যায় জানি না। আত্মা ব্যাপারটা কী তাও পরিষ্কার নয়। যদি তার গমন এমন জায়গায় হয় যেখান থেকে এই মর্ত্য দেখা যায়, তাহলে সোহাগী বালার আত্মা আমাদের সভ্য-ভব্য-সংস্কৃতি মিথ্যাবাদী আর হিপোক্র্যাটদের যাবতীয় বাগাড়ম্বরে পেচ্ছাপ করে দিতে চেয়েছে নিশ্চয়ই।
আর বারের মতো এবারো সরকার মঙ্গা অবস্থাকে অস্বীকার করবে। সরকারের খুদকুড়ো খাওয়া অর্থনীতিবিদরা রেখাচিত্র আর গ্রাফ-ট্রাফ এঁকে প্রমাণ করবে অর্থনীতিতে প্রভূত উন্নতি সাধিত হচ্ছে। ৭২ শতাংশ বৈদেশিক বিনিয়োগ বেড়েছে। রেমিট্যান্সের জোয়ারে ব্যাংকের ভল্ট ফুলেফেঁপে উঠছে। প্রবৃদ্ধি সাড়ে পাঁচ হয়ে গেছে। এখন সাত-আট হওয়ার অপো। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের এক অংশ এটা প্রমাণে নিবিষ্ট হবেন যে, ওই মৃত্যুগুলো অনাহারে মৃত্যু নয়। তারা আসলে রোগে ভুগে ভুল চিকিৎসায় মরে। আমাদের চিকিৎসকেরা রাজনীতিবিদদের মতোই কূটকৌশলী। মতলববাজ। তারা একাধারে ‘কেন রোগী যথা সময়ে আমার স্মরণাপন্ন হলো না’ সেই খামারী দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ‘হায়াৎ-মউৎ আল্লার হাতে’ বলে হাত উল্টিয়ে দেখাবে ‘এই দেখো আমার হাতে নেই’। মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, নেতা, চেয়ারম্যান, মেম্বর, জোতদার, ভুঁড়িঅলা তেল চকচকা হুজুর সকলেই নির্জলা মিথ্যার ফ্যানা লাগামে লাগিয়ে চিৎকার করে আরো অ্যানা তুলে বলবেন ' দেশে এখন পর্যন্ত কেউ না কেয়ে মরেনি। কাউকে না খেয়ে মরতে দেওয়া হবে না (স্বাভাবিক মৃত্যুর সময়ও জোর করে ধান, গম, প্যাকেটসহ আটা গিলিয়ে দেওয়া হবে)'। কেননা গিলিয়ে মানুষ বাঁচিয়ে রাখা তাদের পবিত্র দায়িত্ব। আর ‘পবিত্র’ কাজে অবহেলা কদাপি নয়।
দেশে যে শত শত এনজিও নামক ক্লাসিফাইড ভিক্ষুক আর মহাজনী সুদখোর সংস্থা আছে তারা ঢোলডগর বাজিয়ে ছুটে যাবেন মঙ্গাপীড়িত অঞ্চলে। তাঁবু টাঙাবেন। সামিয়ানা টাঙাবেন। ঘরে ঘরে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ করবেন। স্যানিটেশন সম্পর্কে সচেতন করবেন। কূয়া পায়খানার উপকারিতা নিয়ে কর্মশালা করবেন, কিন্তু কিছুতেই চোখের সামনে সোহাগী বালাদের উত্তরসূরি মনসুর আলী, সামিনা, ফুল বালাদের খুঁজে পাবেন না। আবার ফিরে আসবেন ঢাকা এলাকার ঠাণ্ডা অফিস ঘরটিতে। কম্পিউটার আঙ্গুল চালিয়ে অফসেট পেপারে প্রতিবেদন লিখবেন... ওই অঞ্চলে ক্ষুদ্র ঋণ যথাযথভাবে বিতরণ হয়নি, প্রকৃতির সঙ্গে কো-অর্ডিনেশনটা পারফেক্ট হয়নি, বণ্টন ব্যবস্থায় কিছুটা গলদ ছিল, তাই এই হঠাৎ মিস ম্যানেজমেন্ট। প্রতিবেদন হাওয়াই জাহাজে পশ্চিমে যাবে। পশ্চিম থেকে ডলার উড়ে আসবে পুবে। এক সময় চড়া সুদে ব্যাংক বাণিজ্যের কর্ণধার ইউনুস সাহেবের জন্য আরো নোবেল উড়ে আসবে।
কুড়িগ্রাম। আমাদের ধমনিতে ডলার প্রবাহ সহ্চালনের শিরা-উপশিরা। আহা মঙ্গা! আমাদের ই-গভর্নেন্স চালু রাখার বারিয়েল গ্রাউন্ড!
হিজ হাইনেস সরকারপ্রধান কী জানেন কতো টাকা হলে আস্ত কুড়িগ্রামকে সারা বছর বসিয়ে খাওয়ানো যায়? তিনি কী জানেন মন্ত্রী-সাংসদদের হাল ফ্যাশনের গাড়ি আমদানির টাকাগুলো দিয়ে কতো হাজার ফুলবালাদের তিন বেলা ভাত খাওয়ানো যায়? আলবৎ জানেন। কিন্তু তাকে গৌরীসেনরা বলেছে ৩০০ কোটি টাকা ঢাকার ফুটপাথ আর ডিভাইডারে শুইয়ে দাও। ৩০০ কোটি টাকার ফুলের টব দিয়ে ব্যালকনি ভরে দাও। দক্ষিণা বাতাস যেন প্লাস্টিক ফুলের গন্ধ মেখে ঘরে ঢোকে। তার সরকারের হিসাবে দু'দশ টাকা কোনো টাকা নয়। টাকা বলতে বোঝায় শত কোটি, হাজার কোটি। তথাকথিত গণতন্ত্রেই যেখানে মানুষের খাওয়া-পরার অধিকার নিশ্চিত করে না, সেখানে আমাদের ‘সামরিক মোল্লাতন্ত্রে’ না খেয়ে মরার কোনো অনুচ্ছেদ নেই। না খেয়ে মরতে দেওয়া যাবে না, এই মর্মে কোনো এজেন্ডা নেই। কোনো নির্বাচনী ওয়াদা নেই। ওয়াদা আছে উন্নয়নের। সেটা তো হচ্ছেই। হুঁ হুঁ করে বাজারের উন্নয়ন হচ্ছে।
বাজারবিমূখ বখাটে ছোঁড়াটাও এখন বাজারের খবর রাখে। আর সরকারের নির্বাচনী ওয়াদা মতে না খেয়ে মরাটাও এক ধরনের উন্নয়ন। জন্ম বিস্ফোরণ রোধ করার উন্নয়ন।
আমাদের দেশে তো সবকিছু নিয়ে ব্যবসা হয়। একসময় বাঙালির দুশমনরা বলতো ‘বাঙালি বেওসা জানে না’'। ভুল। কে বলে বাঙালি ব্যবসা জানে না? বাঙালি জীবন নিয়ে ব্যবসা করে, মৃত্যু নিয়ে ব্যবসা করে, লাশ নিয়ে ব্যবসা করে, ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করে, পরিবার নিয়ে ব্যবসা করে, রাজনীতি নিয়ে তো করেই, কেননা রাজনীতি স্বয়ং একটা ব্যবসা। বাঙালি রোজা নিয়ে ব্যবসা করে, ইফতার নিয়ে ব্যবসা করে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ব্যবসা করে, বেজন্মা-জারজত্ব নিয়ে ব্যবসা করে। যারা মঙ্গা নিয়ে ব্যবসা করতে চান তারা রেডি হয়ে যান। এবার মঙ্গা আর রমজান হাত ধরাধরি করে আসছে।
অনাহার আর অতি- আহার একসঙ্গে আসছে। সাহরি আর ফ্যানাভাত গলাগলি করে আসছে। বড়ো বড়ো শহরে ইফতার তার খুশবু ছড়াবে চারপাশ থেকে। কুড়িগ্রাম আর উত্তরাঞ্চলে মৃত লাশের পাশে কর্পুরের গন্ধ ছড়াবে চারপাশ থেকে। ঢাকার শপিং মলগুলো লজ্জা দেবে সিঙ্গাপুর-ব্যাংকককে। কুড়িগ্রামের অনাহারে মৃত লাশগুলো লজ্জা দেবে ইথিওপিয়াকে। কেবলই আমরা লজ্জা পাবো না, যারা ফি বছর বন্যা এলে গান গাই, মঙ্গা এলে কলাম লিখি, খরা এলে মোনাজাত করি, সাইক্লোন এলে নির্লজ্জের মতো বলি' আমাদের দেশের মানুষ অসম সাহসী, তারা দুর্যোগ কাটিয়ে জীবনযুদ্ধে জীয় হয়!' কেবলই আমরা লজ্জা পাবো না, যারা সারা রাত হাঁসের মতো গিলে সকালে ফ্লাশ করে দিই পাঁচজনের খাবার। পাঁচজনের জীবন। পাঁচজনের অধিকার।
নিলফামারীর চাপড়াসবমজানী ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নের বড় ঢিংপাড়া, ছোট ঢিংপাড়া, চেয়ারম্যানপাড়া, গ্রামগুলোতে একশ ভাগ মানুষ বেকার। কর্মহীন। সারা বছরই তাদের যুদ্ধ করে জীবন বাঁচিয়ে রাখতে হয়। সেই যুদ্ধে কোনো আত্মঘাতী বোমা নেই। একে-৪৭ নেই, কালাশনিকভ নেই। আছে ঠাণ্ডা যুদ্ধের ভয়াবহতা। সাদা সাদা ফোলা ফোলা নরম এক ধরনের বস্তু যার নাম ভাত। সেই ভাতের প্রাপ্যতা নয়, ভাতের জোগাড় নিয়ে এই যুদ্ধ। সারা বছরের টানাটানির সংসারে আশ্বিন-কার্তিক এলেই আর চলে না। সময় যেন থমকে দাঁড়ায়। সূর্যটা সেই যে ওঠে, গনগনে আগুনের মতো আর যেন ডোবে না। সে যতো তাপ ছড়ায়, যতো ঘাস পুড়িয়ে দেয়, যতো পাতা জলশূন্য করে তারচেয়ে ঢের দহনে জ্বলতে তাকে পেটের আগুন। দাউ দাউ করে জ্বলে। নিলফামারী না খেতে পেয়ে মরার জন্য বিখ্যাত নয়। এ বেলায় এগিয়ে কুড়িগ্রাম।
গেলো বছর এই সময়ে কুড়িগ্রামের এক প্রত্যন্ত গ্রামে খেতে না পেয়ে মরে গেয়েছিল সোহাগী বালা। নিউজপ্রিন্টের ওপর তোবড়ানো গাল সোহাগী বালার ছবিটা ছাপা হয়েছিল ভোরের কাগজে। ওই চবিটা মুখ বাঁকা করে ব্যঙ্গ করেছিল আমাদের সভ্যতাকে। আমাদের জাঁকজৌলুসকে। ওই ছবিটা ছাপা হওয়ার পরও আমরা আদিম যুগের গুহা মানবের মতো বেহায়া হয়ে কাড়ি কাড়ি ভাত গিলেছিলাম। ভাতগুলো সুস্বাদু করতে নানাবিধ ব্যাঞ্জন মিশিয়েছিলাম। অতি ভোজনের পর কার্বোনেটেড পানীয় পান করেছিলাম। ঢাকার কোটি খানেক মানুষের জীবনে কোনোই ব্যতিক্রম হয়নি সোহাগী বালা উপাখ্যান।
এক বছর বাদে আবারো সোহাগী বালাদের নিয়ে লিখতে গিয়ে মনে পড়ছে, ওর পরে আমরা রাশি রাশি নিউজপ্রিন্ট খরচ করেছি রাজনীতির নোংরা ঘাঁটতে ঘাঁটতে। আত্মা-টাত্মা কোথায় যায় জানি না। আত্মা ব্যাপারটা কী তাও পরিষ্কার নয়। যদি তার গমন এমন জায়গায় হয় যেখান থেকে এই মর্ত্য দেখা যায়, তাহলে সোহাগী বালার আত্মা আমাদের সভ্য-ভব্য-সংস্কৃতি মিথ্যাবাদী আর হিপোক্র্যাটদের যাবতীয় বাগাড়ম্বরে পেচ্ছাপ করে দিতে চেয়েছে নিশ্চয়ই।
আর বারের মতো এবারো সরকার মঙ্গা অবস্থাকে অস্বীকার করবে। সরকারের খুদকুড়ো খাওয়া অর্থনীতিবিদরা রেখাচিত্র আর গ্রাফ-ট্রাফ এঁকে প্রমাণ করবে অর্থনীতিতে প্রভূত উন্নতি সাধিত হচ্ছে। ৭২ শতাংশ বৈদেশিক বিনিয়োগ বেড়েছে। রেমিট্যান্সের জোয়ারে ব্যাংকের ভল্ট ফুলেফেঁপে উঠছে। প্রবৃদ্ধি সাড়ে পাঁচ হয়ে গেছে। এখন সাত-আট হওয়ার অপো। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের এক অংশ এটা প্রমাণে নিবিষ্ট হবেন যে, ওই মৃত্যুগুলো অনাহারে মৃত্যু নয়। তারা আসলে রোগে ভুগে ভুল চিকিৎসায় মরে। আমাদের চিকিৎসকেরা রাজনীতিবিদদের মতোই কূটকৌশলী। মতলববাজ। তারা একাধারে ‘কেন রোগী যথা সময়ে আমার স্মরণাপন্ন হলো না’ সেই খামারী দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ‘হায়াৎ-মউৎ আল্লার হাতে’ বলে হাত উল্টিয়ে দেখাবে ‘এই দেখো আমার হাতে নেই’। মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, নেতা, চেয়ারম্যান, মেম্বর, জোতদার, ভুঁড়িঅলা তেল চকচকা হুজুর সকলেই নির্জলা মিথ্যার ফ্যানা লাগামে লাগিয়ে চিৎকার করে আরো অ্যানা তুলে বলবেন ' দেশে এখন পর্যন্ত কেউ না কেয়ে মরেনি। কাউকে না খেয়ে মরতে দেওয়া হবে না (স্বাভাবিক মৃত্যুর সময়ও জোর করে ধান, গম, প্যাকেটসহ আটা গিলিয়ে দেওয়া হবে)'। কেননা গিলিয়ে মানুষ বাঁচিয়ে রাখা তাদের পবিত্র দায়িত্ব। আর ‘পবিত্র’ কাজে অবহেলা কদাপি নয়।
দেশে যে শত শত এনজিও নামক ক্লাসিফাইড ভিক্ষুক আর মহাজনী সুদখোর সংস্থা আছে তারা ঢোলডগর বাজিয়ে ছুটে যাবেন মঙ্গাপীড়িত অঞ্চলে। তাঁবু টাঙাবেন। সামিয়ানা টাঙাবেন। ঘরে ঘরে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ করবেন। স্যানিটেশন সম্পর্কে সচেতন করবেন। কূয়া পায়খানার উপকারিতা নিয়ে কর্মশালা করবেন, কিন্তু কিছুতেই চোখের সামনে সোহাগী বালাদের উত্তরসূরি মনসুর আলী, সামিনা, ফুল বালাদের খুঁজে পাবেন না। আবার ফিরে আসবেন ঢাকা এলাকার ঠাণ্ডা অফিস ঘরটিতে। কম্পিউটার আঙ্গুল চালিয়ে অফসেট পেপারে প্রতিবেদন লিখবেন... ওই অঞ্চলে ক্ষুদ্র ঋণ যথাযথভাবে বিতরণ হয়নি, প্রকৃতির সঙ্গে কো-অর্ডিনেশনটা পারফেক্ট হয়নি, বণ্টন ব্যবস্থায় কিছুটা গলদ ছিল, তাই এই হঠাৎ মিস ম্যানেজমেন্ট। প্রতিবেদন হাওয়াই জাহাজে পশ্চিমে যাবে। পশ্চিম থেকে ডলার উড়ে আসবে পুবে। এক সময় চড়া সুদে ব্যাংক বাণিজ্যের কর্ণধার ইউনুস সাহেবের জন্য আরো নোবেল উড়ে আসবে।
কুড়িগ্রাম। আমাদের ধমনিতে ডলার প্রবাহ সহ্চালনের শিরা-উপশিরা। আহা মঙ্গা! আমাদের ই-গভর্নেন্স চালু রাখার বারিয়েল গ্রাউন্ড!
হিজ হাইনেস সরকারপ্রধান কী জানেন কতো টাকা হলে আস্ত কুড়িগ্রামকে সারা বছর বসিয়ে খাওয়ানো যায়? তিনি কী জানেন মন্ত্রী-সাংসদদের হাল ফ্যাশনের গাড়ি আমদানির টাকাগুলো দিয়ে কতো হাজার ফুলবালাদের তিন বেলা ভাত খাওয়ানো যায়? আলবৎ জানেন। কিন্তু তাকে গৌরীসেনরা বলেছে ৩০০ কোটি টাকা ঢাকার ফুটপাথ আর ডিভাইডারে শুইয়ে দাও। ৩০০ কোটি টাকার ফুলের টব দিয়ে ব্যালকনি ভরে দাও। দক্ষিণা বাতাস যেন প্লাস্টিক ফুলের গন্ধ মেখে ঘরে ঢোকে। তার সরকারের হিসাবে দু'দশ টাকা কোনো টাকা নয়। টাকা বলতে বোঝায় শত কোটি, হাজার কোটি। তথাকথিত গণতন্ত্রেই যেখানে মানুষের খাওয়া-পরার অধিকার নিশ্চিত করে না, সেখানে আমাদের ‘সামরিক মোল্লাতন্ত্রে’ না খেয়ে মরার কোনো অনুচ্ছেদ নেই। না খেয়ে মরতে দেওয়া যাবে না, এই মর্মে কোনো এজেন্ডা নেই। কোনো নির্বাচনী ওয়াদা নেই। ওয়াদা আছে উন্নয়নের। সেটা তো হচ্ছেই। হুঁ হুঁ করে বাজারের উন্নয়ন হচ্ছে।
বাজারবিমূখ বখাটে ছোঁড়াটাও এখন বাজারের খবর রাখে। আর সরকারের নির্বাচনী ওয়াদা মতে না খেয়ে মরাটাও এক ধরনের উন্নয়ন। জন্ম বিস্ফোরণ রোধ করার উন্নয়ন।
আমাদের দেশে তো সবকিছু নিয়ে ব্যবসা হয়। একসময় বাঙালির দুশমনরা বলতো ‘বাঙালি বেওসা জানে না’'। ভুল। কে বলে বাঙালি ব্যবসা জানে না? বাঙালি জীবন নিয়ে ব্যবসা করে, মৃত্যু নিয়ে ব্যবসা করে, লাশ নিয়ে ব্যবসা করে, ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করে, পরিবার নিয়ে ব্যবসা করে, রাজনীতি নিয়ে তো করেই, কেননা রাজনীতি স্বয়ং একটা ব্যবসা। বাঙালি রোজা নিয়ে ব্যবসা করে, ইফতার নিয়ে ব্যবসা করে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ব্যবসা করে, বেজন্মা-জারজত্ব নিয়ে ব্যবসা করে। যারা মঙ্গা নিয়ে ব্যবসা করতে চান তারা রেডি হয়ে যান। এবার মঙ্গা আর রমজান হাত ধরাধরি করে আসছে।
অনাহার আর অতি- আহার একসঙ্গে আসছে। সাহরি আর ফ্যানাভাত গলাগলি করে আসছে। বড়ো বড়ো শহরে ইফতার তার খুশবু ছড়াবে চারপাশ থেকে। কুড়িগ্রাম আর উত্তরাঞ্চলে মৃত লাশের পাশে কর্পুরের গন্ধ ছড়াবে চারপাশ থেকে। ঢাকার শপিং মলগুলো লজ্জা দেবে সিঙ্গাপুর-ব্যাংকককে। কুড়িগ্রামের অনাহারে মৃত লাশগুলো লজ্জা দেবে ইথিওপিয়াকে। কেবলই আমরা লজ্জা পাবো না, যারা ফি বছর বন্যা এলে গান গাই, মঙ্গা এলে কলাম লিখি, খরা এলে মোনাজাত করি, সাইক্লোন এলে নির্লজ্জের মতো বলি' আমাদের দেশের মানুষ অসম সাহসী, তারা দুর্যোগ কাটিয়ে জীবনযুদ্ধে জীয় হয়!' কেবলই আমরা লজ্জা পাবো না, যারা সারা রাত হাঁসের মতো গিলে সকালে ফ্লাশ করে দিই পাঁচজনের খাবার। পাঁচজনের জীবন। পাঁচজনের অধিকার।
২৭ শে আগস্ট, ২০০৮ রাত ১:৫৮
লেখক বলেছেন: ধন্যবাদ জাহাঙ্গীর আলম আকাশ।
২. ২৬ শে নভেম্বর, ২০১০ বিকাল ৩:০৯
শাওলিন বলেছেন: অসাধারণ লিখেছেন। তিক্ত বাস্তবতা। পড়ে লজ্জা পেলাম। এই ভেবে যে, আমিও এই লেখাটা খুঁজে পেলাম পরশু "উন্নয়ন যোগাযোগ" পরীক্ষার জন্য সার্চ করতে গিয়ে। পরীক্ষার পর আবার সব ভুলে যাবো। নিজের এটা-ওটা না পাওয়ার কষ্টে ডুবে যাবো। আমি, আমরা এমন নির্লজ্জ বলেই উন্নয়ন খাতা কলমে আটকে আছে।
২৭ শে নভেম্বর, ২০১০ রাত ১২:৫৪
লেখক বলেছেন:
অবাক লাগল। আমার আড়াই বছর আগেকার লেখাটা আপনি খুঁজে পেলেন কিভাবে?
যা হোক পেয়ে মন্তব্য করায় আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ।
অবাক লাগল। আমার আড়াই বছর আগেকার লেখাটা আপনি খুঁজে পেলেন কিভাবে?
যা হোক পেয়ে মন্তব্য করায় আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ।
jahangiralamakash@gmail.com