কিছু কিছু ধারণা আছে মানুষের। ধরেই নেওয়া হয় সেই ধারণামতে ব্যাপার গুলো ঘটলেই সব কিছু মনের মত হয়ে যাবে। সব কিছু গ্রহণযোগ্য হয়ে যাবে। মানুষ ভাবে দেশে গণতন্ত্র এলেই দেশের তাবত সমস্যার অবসান হয়ে যাবে! সকল না-পাওয়ার অবসান হয়ে যাবে! এই ধারণায় দেশের ব্যাপক সংখ্যক মানুষ বিশ্বাস করতেন আমাদের বিচার ব্যবস্থা স্বাধীন হলেই বিচার নিয়ে সাধারণ মানুষের সকল দু:খ-কষ্ট,জ্বালা-যন্ত্রনার অবসান ঘটবে! আর তাই বিচার ব্যবস্থাকে স্বাধীনকরা নিয়ে দেশ স্বাধীনের পর থেকেই দেশের বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে বিভিন্ন সেক্টরের মানুষ একধরণের আন্দোলন করে আসছিলেন।লাগাতার এই আন্দোলনের ফসল হিসেবে হোক কিংবা তদারকি সরকারের স্ট্যান্টদেওয়া চিন্তা থেকে হোক, বিচার ব্যবস্থা কাগজে-কলমে স্বাধীন হয়েছে।খুব ঢাকঢোল পিটিয়ে সেই স্বাধীনতার কথা বলাও হয়েছে। এখনো হচ্ছে।
বিচার বিভাগ স্বাধীন মানে কি?তাতে আম নাগরিকের কি উপকার? মোটাদাগে এই প্রশ্নের উত্তর একটু কঠিন। সরলভাবে বলা যায়,বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগ থেকে স্বাধীন মানে আদালতে নির্বাহী বিভাগের কোন কর্তৃত্ব থাকবে না।সরকার তার অপছন্দের ব্যক্তিকেও আইনীপ্যাঁচে আটকে রাখতে পারবে না। আবার নিরাপরাধ ব্যক্তি সরকারের যতই রক্তচুক্ষু থাকুক,আইনের জোরে খালাস পাবে। অন্য অর্থে সরকার তার নির্বাহী ক্ষমতাবলে বিচার বিভাগকে প্রভাবিত করে সরকারের প্রতিপক্ষ বা প্রতিবাদকারীদের আটকে রাখতে পারবে না।এ ধরণের গড় চিন্তা নিয়ে মানুষ বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে প্রাণখুলে সাধুবাদ জানিয়ে ছিল। অসহায় মানুষের শেষ ভরসাস্থল বলে পরিচিত আদালতের ওপর অকুণ্ঠ আস্থা রাখতে চেয়েছিল। সরকারও বিচার বিভাগ স্বাধীন করে একটা বিরাট কর্ম করে ফেলেছি গোছের কৃতিত্ব নিয়েছিল।এর পরে আমরা কি দেখলাম?
দেখলাম তদারকি সরকারের আমলে গেফতারকৃত প্রায় সকল রাজনৈতিক নেতা-কর্মিকে পটাপট জামিন দেওয়া হচ্ছে।এক একজনের ১২/১৪টা মামলা রাতারতি হয় খারিজ হয়ে যাচ্ছে নয়ত জামিন হয়ে যাচ্ছে। তখন সুশীলেরা বলতে শুরু করলেন-এটা হল বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ফসল! সাধারণ মানুষ স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার সুফল পেতে শুরু করেছেন! বেশ। এমনটাই হওয়ার কথা।মানুষ যে আদালত বা বিচার ব্যবস্থার ওপর আস্থা রাখতে চায় তার ভূমিকা এমনই হওয়ার কথা।এরই মধ্যে দেখা গেল বেগম জিয়া এবং তারেক রহমানের মামলাগুলো নিয়ে সরকার আর আদালতের মধ্যে টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। সরকার তাদের দুজনকে মুক্তি দেব দেব করেও দিচ্ছে না, আর বিএনপি এবং চার দলীয় জোট একের পর এক আন্দেলনের হুমকি দিয়ে চলেছে। তার পর কি হলো? রাতারাতি দেখা গেল আদালতে তারেক রহমানের ১২টা মামলায় জামিন হয়ে গেল ! অথচ কয়েকমাস আগে জরুরী আইনের কথা বলে কোন মামলা বা অভিযোগেরই জামিন হচ্ছিল না।জরুরী বিধিমালা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টের রীটও আপিল বিভাগ খারিজ করে দিয়েছিল। তার মানে জরুরী বিধিমালায় সব মামলাই জামিনঅযোগ্য। তাহলে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে,কিছু দিন আগে যে মামলাগুলো জামিন অযোগ্য ছিল তা এখন কি ভাবে জামিনযোগ্য হয়ে গেল? হ্যাঁ, এটাই মিলিয়ন ডলারের কোশ্চেন। ব্যাপারটা এমনি এমনি ঘটেনি।
সরকার যখন খালেদা-তারেকের মুক্তি নিয়ে টালবাহানা করছে,তখন চার দলীয় জোট আন্দোলনের হুমকি দিল। মানব বন্ধন করতে না পেরে বৃহত্তর আন্দোলনের ঘোষণা দিল। তার পর পরই ঘটনাক্রমে তারেক রহমান মাথা ঘুরে বাথরুমে পড়ে গেলেন। ঢাবির ছাত্রদল কর্মিরা রাজপথে নেমে ভাংচুর করল। একজন নিরীহ পথচারিও মারা গেলেন। এই টেম্পুতে চার দল আরো বড় ধরাণের হুমকি দিলে সরকার নড়েচড়ে বসে ‘গুঁজে রাখা কলকাঠি' সরিয়ে নিল’। অর্থাৎ অদৃশ্য ব্যারিয়ার সরিয়ে নিল। আর ঠিক তার পর পরই হুড়মুড় করে আদালতে তারেকের মামলাগুলো জামিন হয়ে গেল। এত করে কি বোঝা গেল?
বোঝা গেল বিচার বিভাগ স্বাধীনটাধীন কোন ব্যাপার নয়। মূল ব্যাপার হলো সরকার কি চাইছে ? সরকার যখনই বেগম জিয়া এবং তারেক রহমান কে নীতিগত ভাবে মুক্তি দিতে চাইল তখনই আদালত জামিন দেওয়া শুরু করল। অর্থাৎ আদালতের সদিচ্ছার প্রতিফলন ঘটানোর জন্য সরকারের সদিচ্ছার প্রতিফলন দরকার হচ্ছে। মোটাদাগে দাঁড়াচ্ছে সরকার চেয়েছে বলেই যেন আদালত চেয়েছে! যত দিন সরকার চায়নি ততদিন আদালতও চায়নি! সরকার যখন অনড় পাথরের মত আদালতও তখন অনড় পাথরের মত। সরকার যখন কিছুটা নরোম,কিছুটা কোমল আদালতও তখন কিছুটা নরোম,কিছুটা কোমল! এই যদি হয় তাহলে কি এই সিদ্ধান্তে আসা যায় না যে, বিচার বিভাগ ঠিক ততটাই স্বাধীন,যতটা সরকার চায় বা পছন্দ করে ? এটা বললে কি খুব অতিশয়োক্তি হবে যে সরকারের মনোভাব যাচাই করে সেইমত আদালত তার ‘স্বাধীনতা’ প্রয়োগ করছে ?
ঠিক এই যুক্তিতেই কি জেল হত্যা মামলার স্বঘোষিত আসামীদের খালাস করে দেওয়া হলো? জেল হত্যা ঘটেছে সেই ১৯৭৫ সালে। সেই থেকে যে হত্যাকারীরা প্রকাশ্যে এই হত্যার দায় স্বীকার করে আসছে ‘সগৌরবে’। সমস্ত তথ্য প্রমানাদি দিয়ে নিম্ন আদালতে যাদের সাজা হয়ে আছে, যারা নিজমুখে হত্যার কথা দেশি-বিদেশি সকল মিডিয়ার কাছে অজস্রবার স্বীকারও করেছে ,তাদের খালাস করে দিয়ে কি আদালত ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠা করল, না ন্যায়নীতির দরোজায় তালা মেরে দিল সেটা আইন বিশারদরাই ভাল বলতে পারবেন। আমরা সাধারণ মানুষ এটা বুঝি যে,আদালতের এই রায়ের পেছনে আদালতের এবং সরকারের কিছু না কিছু 'হিডেন ব্যাপার- স্যাপার' আছে। কি সেই হিডেন ব্যাপার ? তা হয়ত আমরা কোন দিনও জানতে পারব না। হয়তবা একদিন জানতেও পারব।সবই সময় বলে দেবে।
এই রায় সম্পর্কে বিশিষ্ট জন দের কিছু মন্তব্য- “রায়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বলেছেন, আমাদের আদালত কি এতোই অন্ধ যে আত্বস্বীকৃত খুনিদেরও অপরাধ দেখেন না? এই রায় যুক্তিসঙ্গত নয়। তিনি বলেন, এই ধরনের হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার সম্পন্ন না হলে এ দেশে খুনের রাজনীতি অব্যাহত থাকবেই(ভোরের কাগজ,৩০ আগষ্ট,২০০৮)
“জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু তার প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, যে খুনিরা নিজেরা স্বীকার করেছে তাদের খালাস করে দেওয়ার এই রায় গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এই রায় বিচারের নামে প্রহসন ছাড়া আর কিছু হতে পারে না।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, এই রায়ের মধ্য দিয়ে সে কথাই কি প্রমাণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে যে, একটা অলৌকিক শক্তি এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে? একই সঙ্গে তিনি বলেছেন, এই রায়ের মাধ্যমে নির্মম এ হত্যাকাণ্ডের যে ন্যায়বিচার হলো না তা আর বলার অপো রাখে না। সেদিনের এই ঘাতক দলের সঙ্গে নিশ্চই তাদের দেশী-বিদেশী মদদদানকারী শক্তি জড়িত ছিল, তা নাহলে কারাগারের মতো সুরতি স্থানে ঢুকে দীর্ঘ সময় ধরে হত্যাকাণ্ড ঘটানো সম্ভব হতো না।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক রায়কে গভীর ষড়যন্ত্রের ফল ও বিচারের নামে প্রহসন হিসেবে অভিহিত করে বলেছেন, যে শক্তি জাতির জনককে হত্যা করেছে তারাই জাতীয় ৪ নেতাকে হত্যা করেছে এবং তারাই ২১ আগস্ট জাতির জনকের কন্যাকে হত্যার অপচেষ্টা চালিয়েছিল। সব কিছু একই গোষ্ঠীর গভীর ষড়যন্ত্রের ফল। আত্মস্বীকৃত খুনিদের খালাসের পর আজ প্রমাণিত আজো একই গোষ্ঠী বিচার ব্যবস্থাসহ প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করছে। সুতরাং এই অবস্থায় ন্যায়বিচার পাওয়া সম্ভব নয়। তিনি, সকল ষড়যন্ত্র দূর করার জন্য জাতিসংঘের সহায়তা কামনা করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন এবং বলেছেন, বিচার আমাদের আদালত করলেও সত্যিকারের সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে সকল ষড়যন্ত্র বের করার জন্য আন্তর্জাতিক তদন্ত জরুরি।
বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ব্যারিস্টার রফিকুল হক এই রায়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছেন, যারা নিজেরা স্বীকার করেছে তাদের খালাস করে দেওয়ার এই রায় সকলকে ক্ষুব্ধ করেছে। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, আপিল বিভাগে এই রায় টিকবে না।
ড.এম জহির তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, যদি একজনের ক্ষেত্রে নিম্ন আদালতের রায় প্রমাণিত হয় অন্যদের ক্ষেত্রে তা প্রমাণিত না হওয়ার কারণই নেই। তিনিও আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, আপিল বিভাগে এই রায় টিকবে না।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার সফিক আহমেদ এই রায়কে বিচারের নামে প্রহসন হিসেবে অভিহিত করেছেন এবং বলেছেন, এই রায় গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তিনি আরো বলেছেন, যারা নিজেরা স্বীকার করেছেন সেই খুনিরা কিভাবে খালাস পায়?
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নেতৃবৃন্দ গতকাল এক প্রতিবাদলিপিতে রায় প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, কতোগুলো অর্থহীন টেকনিক্যাল ত্রুটির অজুহাত দেখিয়ে আত্মস্বীকৃত ঘাতকদের বেকসুর খালাস দিয়ে ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে আদালত অত্যন্ত কদর্য ও নিন্দনীয় নজির স্থাপন করেছে। বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় ৪ নেতার আত্মস্বীকৃত খুনিদের বেকসুর খালাস প্রদানের এই রায় কেবল বাংলাদেশ নয়, সারাবিশ্বে আইনের মারপ্যাঁচে ঘাতকদের রার এক কলঙ্কজনক দৃষ্টান্ত হিসেবে গণ্য হবে(ঐ)”
আমরা জানিনা উচ্চ আদালতে কি হবে ? আমরা আরো জানিনা তারও পরে কি হবে ? তবে একটা বিষয়ে আমরা এখন আতংকিত যে, আদালতের ওপর মানুষের যে সর্বশেষ আস্থা, আদালত যে সাধারণ মানুষের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল বলে বলা হয় সেই আদালতে যদি এ ধরণের রায় হয় তাহলে আস্থা বা সর্বশেষ আশ্রয়স্থল বা অসহায়ের সর্বশেষ নালিশের জায়গা বলতে আর কি অবশিষ্ট থাকল ? এ কোন প্রলয়ের ঘুণীপাকে পড়ল এ দেশের মানুষ ? মানুষের তাহলে শেষ বিচারের জন্য কোথায় যাওয়ার জায়গা থাকল ? আইন তার নিজ গতিতেই চলবে বলে যে মোক্ষ ধারণা এতকাল ফেরি করে আসা হচ্ছে এ কি সেই মোক্ষ বিচার ? এর পর আর কার কাছে মানুষ বিচার চাইতে যাবে ? কার কাছে বিচার চাইতে পারে ? হায় স্বাধীন দেশ! হায় স্বাধীন গণতন্ত্র ! হায় স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা ! হায় অসহায় মানুষের স্বাধীন হওয়ার বাসনা !
বিচার বিভাগ স্বাধীন মানে কি?তাতে আম নাগরিকের কি উপকার? মোটাদাগে এই প্রশ্নের উত্তর একটু কঠিন। সরলভাবে বলা যায়,বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগ থেকে স্বাধীন মানে আদালতে নির্বাহী বিভাগের কোন কর্তৃত্ব থাকবে না।সরকার তার অপছন্দের ব্যক্তিকেও আইনীপ্যাঁচে আটকে রাখতে পারবে না। আবার নিরাপরাধ ব্যক্তি সরকারের যতই রক্তচুক্ষু থাকুক,আইনের জোরে খালাস পাবে। অন্য অর্থে সরকার তার নির্বাহী ক্ষমতাবলে বিচার বিভাগকে প্রভাবিত করে সরকারের প্রতিপক্ষ বা প্রতিবাদকারীদের আটকে রাখতে পারবে না।এ ধরণের গড় চিন্তা নিয়ে মানুষ বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে প্রাণখুলে সাধুবাদ জানিয়ে ছিল। অসহায় মানুষের শেষ ভরসাস্থল বলে পরিচিত আদালতের ওপর অকুণ্ঠ আস্থা রাখতে চেয়েছিল। সরকারও বিচার বিভাগ স্বাধীন করে একটা বিরাট কর্ম করে ফেলেছি গোছের কৃতিত্ব নিয়েছিল।এর পরে আমরা কি দেখলাম?
দেখলাম তদারকি সরকারের আমলে গেফতারকৃত প্রায় সকল রাজনৈতিক নেতা-কর্মিকে পটাপট জামিন দেওয়া হচ্ছে।এক একজনের ১২/১৪টা মামলা রাতারতি হয় খারিজ হয়ে যাচ্ছে নয়ত জামিন হয়ে যাচ্ছে। তখন সুশীলেরা বলতে শুরু করলেন-এটা হল বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ফসল! সাধারণ মানুষ স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার সুফল পেতে শুরু করেছেন! বেশ। এমনটাই হওয়ার কথা।মানুষ যে আদালত বা বিচার ব্যবস্থার ওপর আস্থা রাখতে চায় তার ভূমিকা এমনই হওয়ার কথা।এরই মধ্যে দেখা গেল বেগম জিয়া এবং তারেক রহমানের মামলাগুলো নিয়ে সরকার আর আদালতের মধ্যে টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। সরকার তাদের দুজনকে মুক্তি দেব দেব করেও দিচ্ছে না, আর বিএনপি এবং চার দলীয় জোট একের পর এক আন্দেলনের হুমকি দিয়ে চলেছে। তার পর কি হলো? রাতারাতি দেখা গেল আদালতে তারেক রহমানের ১২টা মামলায় জামিন হয়ে গেল ! অথচ কয়েকমাস আগে জরুরী আইনের কথা বলে কোন মামলা বা অভিযোগেরই জামিন হচ্ছিল না।জরুরী বিধিমালা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টের রীটও আপিল বিভাগ খারিজ করে দিয়েছিল। তার মানে জরুরী বিধিমালায় সব মামলাই জামিনঅযোগ্য। তাহলে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে,কিছু দিন আগে যে মামলাগুলো জামিন অযোগ্য ছিল তা এখন কি ভাবে জামিনযোগ্য হয়ে গেল? হ্যাঁ, এটাই মিলিয়ন ডলারের কোশ্চেন। ব্যাপারটা এমনি এমনি ঘটেনি।
সরকার যখন খালেদা-তারেকের মুক্তি নিয়ে টালবাহানা করছে,তখন চার দলীয় জোট আন্দোলনের হুমকি দিল। মানব বন্ধন করতে না পেরে বৃহত্তর আন্দোলনের ঘোষণা দিল। তার পর পরই ঘটনাক্রমে তারেক রহমান মাথা ঘুরে বাথরুমে পড়ে গেলেন। ঢাবির ছাত্রদল কর্মিরা রাজপথে নেমে ভাংচুর করল। একজন নিরীহ পথচারিও মারা গেলেন। এই টেম্পুতে চার দল আরো বড় ধরাণের হুমকি দিলে সরকার নড়েচড়ে বসে ‘গুঁজে রাখা কলকাঠি' সরিয়ে নিল’। অর্থাৎ অদৃশ্য ব্যারিয়ার সরিয়ে নিল। আর ঠিক তার পর পরই হুড়মুড় করে আদালতে তারেকের মামলাগুলো জামিন হয়ে গেল। এত করে কি বোঝা গেল?
বোঝা গেল বিচার বিভাগ স্বাধীনটাধীন কোন ব্যাপার নয়। মূল ব্যাপার হলো সরকার কি চাইছে ? সরকার যখনই বেগম জিয়া এবং তারেক রহমান কে নীতিগত ভাবে মুক্তি দিতে চাইল তখনই আদালত জামিন দেওয়া শুরু করল। অর্থাৎ আদালতের সদিচ্ছার প্রতিফলন ঘটানোর জন্য সরকারের সদিচ্ছার প্রতিফলন দরকার হচ্ছে। মোটাদাগে দাঁড়াচ্ছে সরকার চেয়েছে বলেই যেন আদালত চেয়েছে! যত দিন সরকার চায়নি ততদিন আদালতও চায়নি! সরকার যখন অনড় পাথরের মত আদালতও তখন অনড় পাথরের মত। সরকার যখন কিছুটা নরোম,কিছুটা কোমল আদালতও তখন কিছুটা নরোম,কিছুটা কোমল! এই যদি হয় তাহলে কি এই সিদ্ধান্তে আসা যায় না যে, বিচার বিভাগ ঠিক ততটাই স্বাধীন,যতটা সরকার চায় বা পছন্দ করে ? এটা বললে কি খুব অতিশয়োক্তি হবে যে সরকারের মনোভাব যাচাই করে সেইমত আদালত তার ‘স্বাধীনতা’ প্রয়োগ করছে ?
ঠিক এই যুক্তিতেই কি জেল হত্যা মামলার স্বঘোষিত আসামীদের খালাস করে দেওয়া হলো? জেল হত্যা ঘটেছে সেই ১৯৭৫ সালে। সেই থেকে যে হত্যাকারীরা প্রকাশ্যে এই হত্যার দায় স্বীকার করে আসছে ‘সগৌরবে’। সমস্ত তথ্য প্রমানাদি দিয়ে নিম্ন আদালতে যাদের সাজা হয়ে আছে, যারা নিজমুখে হত্যার কথা দেশি-বিদেশি সকল মিডিয়ার কাছে অজস্রবার স্বীকারও করেছে ,তাদের খালাস করে দিয়ে কি আদালত ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠা করল, না ন্যায়নীতির দরোজায় তালা মেরে দিল সেটা আইন বিশারদরাই ভাল বলতে পারবেন। আমরা সাধারণ মানুষ এটা বুঝি যে,আদালতের এই রায়ের পেছনে আদালতের এবং সরকারের কিছু না কিছু 'হিডেন ব্যাপার- স্যাপার' আছে। কি সেই হিডেন ব্যাপার ? তা হয়ত আমরা কোন দিনও জানতে পারব না। হয়তবা একদিন জানতেও পারব।সবই সময় বলে দেবে।
এই রায় সম্পর্কে বিশিষ্ট জন দের কিছু মন্তব্য- “রায়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বলেছেন, আমাদের আদালত কি এতোই অন্ধ যে আত্বস্বীকৃত খুনিদেরও অপরাধ দেখেন না? এই রায় যুক্তিসঙ্গত নয়। তিনি বলেন, এই ধরনের হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার সম্পন্ন না হলে এ দেশে খুনের রাজনীতি অব্যাহত থাকবেই(ভোরের কাগজ,৩০ আগষ্ট,২০০৮)
“জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু তার প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, যে খুনিরা নিজেরা স্বীকার করেছে তাদের খালাস করে দেওয়ার এই রায় গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এই রায় বিচারের নামে প্রহসন ছাড়া আর কিছু হতে পারে না।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, এই রায়ের মধ্য দিয়ে সে কথাই কি প্রমাণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে যে, একটা অলৌকিক শক্তি এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে? একই সঙ্গে তিনি বলেছেন, এই রায়ের মাধ্যমে নির্মম এ হত্যাকাণ্ডের যে ন্যায়বিচার হলো না তা আর বলার অপো রাখে না। সেদিনের এই ঘাতক দলের সঙ্গে নিশ্চই তাদের দেশী-বিদেশী মদদদানকারী শক্তি জড়িত ছিল, তা নাহলে কারাগারের মতো সুরতি স্থানে ঢুকে দীর্ঘ সময় ধরে হত্যাকাণ্ড ঘটানো সম্ভব হতো না।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক রায়কে গভীর ষড়যন্ত্রের ফল ও বিচারের নামে প্রহসন হিসেবে অভিহিত করে বলেছেন, যে শক্তি জাতির জনককে হত্যা করেছে তারাই জাতীয় ৪ নেতাকে হত্যা করেছে এবং তারাই ২১ আগস্ট জাতির জনকের কন্যাকে হত্যার অপচেষ্টা চালিয়েছিল। সব কিছু একই গোষ্ঠীর গভীর ষড়যন্ত্রের ফল। আত্মস্বীকৃত খুনিদের খালাসের পর আজ প্রমাণিত আজো একই গোষ্ঠী বিচার ব্যবস্থাসহ প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করছে। সুতরাং এই অবস্থায় ন্যায়বিচার পাওয়া সম্ভব নয়। তিনি, সকল ষড়যন্ত্র দূর করার জন্য জাতিসংঘের সহায়তা কামনা করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন এবং বলেছেন, বিচার আমাদের আদালত করলেও সত্যিকারের সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে সকল ষড়যন্ত্র বের করার জন্য আন্তর্জাতিক তদন্ত জরুরি।
বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ব্যারিস্টার রফিকুল হক এই রায়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছেন, যারা নিজেরা স্বীকার করেছে তাদের খালাস করে দেওয়ার এই রায় সকলকে ক্ষুব্ধ করেছে। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, আপিল বিভাগে এই রায় টিকবে না।
ড.এম জহির তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, যদি একজনের ক্ষেত্রে নিম্ন আদালতের রায় প্রমাণিত হয় অন্যদের ক্ষেত্রে তা প্রমাণিত না হওয়ার কারণই নেই। তিনিও আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, আপিল বিভাগে এই রায় টিকবে না।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার সফিক আহমেদ এই রায়কে বিচারের নামে প্রহসন হিসেবে অভিহিত করেছেন এবং বলেছেন, এই রায় গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তিনি আরো বলেছেন, যারা নিজেরা স্বীকার করেছেন সেই খুনিরা কিভাবে খালাস পায়?
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নেতৃবৃন্দ গতকাল এক প্রতিবাদলিপিতে রায় প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, কতোগুলো অর্থহীন টেকনিক্যাল ত্রুটির অজুহাত দেখিয়ে আত্মস্বীকৃত ঘাতকদের বেকসুর খালাস দিয়ে ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে আদালত অত্যন্ত কদর্য ও নিন্দনীয় নজির স্থাপন করেছে। বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় ৪ নেতার আত্মস্বীকৃত খুনিদের বেকসুর খালাস প্রদানের এই রায় কেবল বাংলাদেশ নয়, সারাবিশ্বে আইনের মারপ্যাঁচে ঘাতকদের রার এক কলঙ্কজনক দৃষ্টান্ত হিসেবে গণ্য হবে(ঐ)”
আমরা জানিনা উচ্চ আদালতে কি হবে ? আমরা আরো জানিনা তারও পরে কি হবে ? তবে একটা বিষয়ে আমরা এখন আতংকিত যে, আদালতের ওপর মানুষের যে সর্বশেষ আস্থা, আদালত যে সাধারণ মানুষের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল বলে বলা হয় সেই আদালতে যদি এ ধরণের রায় হয় তাহলে আস্থা বা সর্বশেষ আশ্রয়স্থল বা অসহায়ের সর্বশেষ নালিশের জায়গা বলতে আর কি অবশিষ্ট থাকল ? এ কোন প্রলয়ের ঘুণীপাকে পড়ল এ দেশের মানুষ ? মানুষের তাহলে শেষ বিচারের জন্য কোথায় যাওয়ার জায়গা থাকল ? আইন তার নিজ গতিতেই চলবে বলে যে মোক্ষ ধারণা এতকাল ফেরি করে আসা হচ্ছে এ কি সেই মোক্ষ বিচার ? এর পর আর কার কাছে মানুষ বিচার চাইতে যাবে ? কার কাছে বিচার চাইতে পারে ? হায় স্বাধীন দেশ! হায় স্বাধীন গণতন্ত্র ! হায় স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা ! হায় অসহায় মানুষের স্বাধীন হওয়ার বাসনা !
লেখাটির বিষয়বস্তু(ট্যাগ/কি-ওয়ার্ড): জেল হত্যা, আদালত, বেকসুর খালাস ;
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জুন, ২০১০ বিকাল ৪:২৮
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জুন, ২০১০ বিকাল ৪:২৮
১. ৩১ শে আগস্ট, ২০০৮ রাত ১:২৯
রাতমজুর বলেছেন: কে যেন ব্লগে একবার কমেন্ট করেছিলেন "স্বাধীন বিচার বিভাগ মানে সরকারের স্বাধীন ভাবে বিচার বিভাগে হস্থক্ষেপ" এই জাতীয় একটা। সেটাই বোধহয় ঠিক বাস্তবে।
৩১ শে আগস্ট, ২০০৮ রাত ২:৩০
লেখক বলেছেন: হ্যাঁ সেটাই ঠিক। স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা আর স্যান্ডোগেঞ্জির বুক পকেট এক কথা।
২. ৩১ শে আগস্ট, ২০০৮ রাত ১:৪৩
একরামুল হক শামীম বলেছেন: স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা নিয়ে অনেক আক্ষেপ রয়ে গেছে আমাদের।
আইনের ছাত্র হিসাবে স্বাধীন বিচার বিভাগের প্রেক্ষাপট ও বাস্তবতা নিয়ে একটা পোস্ট লেখার ইচ্ছা আছে।
আইনের ছাত্র হিসাবে স্বাধীন বিচার বিভাগের প্রেক্ষাপট ও বাস্তবতা নিয়ে একটা পোস্ট লেখার ইচ্ছা আছে।
৩১ শে আগস্ট, ২০০৮ রাত ২:৩২
লেখক বলেছেন: দ্রুত আক্ষেপ মেটানোর ব্যবস্থা নিন শামীম।আপনার লেখার অপেক্ষায় থাকলাম।আমি আইন কম বুঝি বলে তলিয়ে ঘাটতে চাই না।ধন্যবাদ।
৩. ৩১ শে আগস্ট, ২০০৮ রাত ৩:২৮
দূরন্ত বলেছেন: বিচার বিভাগে আসুলে একটা ব্যাপক পরিবর্তন দরকার। নাহলে সাধারণ মানুষের ন্যায় বিচার প্রাপ্তির আশা কোনোদিনই পূরণ হবে না...
পোস্টের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনার নিজের লেখা?
পোস্টের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনার নিজের লেখা?
৩১ শে আগস্ট, ২০০৮ বিকাল ৩:০৬
লেখক বলেছেন:
হ্যাঁরে ভাই,এই অধমেরই লেখা। এ অধম প্রথমত: কলাম লেখক, পরে অন্য কিছু। এই লেখাটাই কাল সোমবার ভোরের কাগজে ছাপা হবে।
আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ।
হ্যাঁরে ভাই,এই অধমেরই লেখা। এ অধম প্রথমত: কলাম লেখক, পরে অন্য কিছু। এই লেখাটাই কাল সোমবার ভোরের কাগজে ছাপা হবে।
আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ।
৪. ৩১ শে আগস্ট, ২০০৮ ভোর ৬:১৮
৫. ৩১ শে আগস্ট, ২০০৮ বিকাল ৩:০৭
৬. ০১ লা সেপ্টেম্বর, ২০০৮ রাত ৯:৫৫
রাতমজুর বলেছেন: ইন্টারন্যাশনাল ব্লগ ডে ২০০৮ এর আড্ডা ছিলো, ভুল করে অন্য লিংক দিয়ে ফেলেছিলাম, স্যরি।
আসলে হবে এই দুটো:
Click This Link
Click This Link
আসলে হবে এই দুটো:
Click This Link
Click This Link
৭. ০১ লা সেপ্টেম্বর, ২০০৮ রাত ১১:৩২
রাতমজুর বলেছেন: আগামীবার আপনার ইমেইলে জানাবো, একটা লেখায় আপনার ইমেইল ঠিকানা পেলাম।