১২ ফেব, ২০১১

এন্টি গল্প > শেষরাতের একফালি চাঁদ > ২৯ শে আগস্ট, ২০০৮ রাত ১০:০০


জীবনে কখনো কখনো এরকম হয়। সচেতন ভাবে ডেমনেস্ট্রেশনকরা থাকলেও অকস্মাত্ পরিস্থিতিতে সব গুলিয়ে যায়। প্রবল ভাবে প্রাকটিস করা বিষয়গুলোও মেলে না। যেদিন মুশফিকা মন্টুর ড্রয়ার খুলে ময়লা কাগজে নির্মোহ কাটা কাটা শব্দের লিফলেট দেখেছিলেন, লিফলেটের কাটা কাটা কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়েছিলেন সেদিন থেকেই নিজের অজান্তে এ ধরণের একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার জন্য নিজেকে তৈরি করেছিলেন। আজ যখন সত্যি সত্যিই সেই পরিস্থিতি সামনে এসে দাঁড়াল তখন মুশফিকা কিছুতেই অনুশীলন করা সেই স্বাভাবিকতা ধরে রাখতে পারলেন না।

ব্যালকনি থেকে গলিমুখটা পুরো দেখা যায় না।রিক্সার শব্দ শুনলেই তিনি ব্যালকনিতে ছুঁটে যাচ্ছিলেন। গ্রিলের সঙ্গে নাক-কপাল ঠেকিয়ে দেখার চেষ্টা করছিলেন। আবার ধীর পায়ে খাবার টেবিলে এসে বসছিলেন। ডাইনিং রুমের দেওয়াল ঘড়িটা অনবরত টিক টিক করে ছুঁটে চলেছে। দশটা...এগারোটা...সাড়েএগারটা.......

আড়াই রুমের এই বাড়িতে মাত্র দু'জনের বাস । মুশফিকা,আর মন্টু। বড় তিন মেয়ে ক্রমান্বয়ে বিয়ে,সন্তান সন্ততি,স্বামী-সংসার,এ্যাম্বিশন,নাগরিকজীবনের সময়হীনতায় ব্যস্ততা,নাড়ির বন্ধনের রিপ্লেসমেন্টে টেলিফোনিক বন্ধন,অত:পর বড় ধরণের একটা ড্যাস।

৮৮৩২২৬......হ্যালো...মা ! এত রাতে ? মন্টু ফেরেনি ? তো টেন্স করছ কেন মা ? ফিরবে,তুমি ভেব না, এরকম হয় না মাঝে মাঝে ?হ্যাঁ মা ওতো বড় হয়েছে না? ও কে, রাখছি মা...বাই....

৯৩৪০০২.....ইলোরা তোরা ঘুমিয়ে পড়েছিলিস? অ। না এখনো খাইনি। মন্টু ফেরেনি এখনো....না না এরকম তো দেরি করে না কখনো.....হ্যাঁ ভয় করছে...ফোন করিস....

৭২০৬৫৯....অজন্তা...হ্যাঁ আমি.....মন্টু....না থানায় ফোন করিনি...শাহেদকে একটু বলবি ? কি? কি রেডি করছে? ও.. আচ্ছা ছাড়ছি...।

কোন অস্বভাবিকতা নেই। অজন্তা ,ইলোরা ,রুবি সকলেই নিশ্চিত মন্টু একটু পরেই ফিরবে। মায়ের মন বরাবরই একটু ব্যাকুল হয়, মা'রা বরাবরই একটু বেশি টেন্স ফিল করে,মন্টু বড় হয়েছে,বন্ধু-বান্ধব,আড্ডা...মা আসলে মেনে নিতে পারেন না...সময়টা ভিষণরকম ফাস্ট ...এ্যালিয়েনেশন বাড়ছে ...মা মনে করে মন্টু সেই ছোটটিই রয়ে গেছে.......এভাবেই মন্টু কেসটা ইজি ভেবে নিজেদের টাইম মেশিনে সপে দিয়ে টাইম স্কেপ করে যায় ইলোরা,অজন্তা,রুবি।

রাত ২টা। খাবার টেবিল অস্পৃশ্যই থেকে গেল। মুশফিকা ৫১বছরের শরীরটা জোর করে নিয়ে সোফায় বসালেন। টিভি অন করলেন। যা দেখেন না তাই দেখতে চাইলেন ভুলে থাকার জন্য। ক্যুইজশো। আইটেম সঙ। আইটেম ডান্স। ১৮রেটেড ফিল্ম। লাফটার শো....টিভি স্কিনে মন্টুর কালোপনা মুখটা ভেসে উঠতেই বন্ধ করে দিলেন।

অজন্তাদের বাবা মৃত্যুকালে যা রেখে গেছিলেন তা দিয়ে তিন মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। কিছু শেয়ার কেনা ছিল,মুশফিকার বিলেতপ্রবাসী ভাইয়ের পাঠানো টাকা দিয়ে কিছু থ্রীএমএস সঞ্চয়পত্র। দিন চলে যায়। ২০বছরের মুশফিকা মুমু যেদিন এবাড়ির বউ হয়ে এলেন......হঠাত্ ফোনটা বেজে ওঠে। বিদ্যুত্ তাড়িতের মত দৌড়ে যান মুশফিকা....হ্যাঁ হ্যাঁ আমি ফোন করেছিলাম....কি ?...'শুনুন আমরা কোয়ারি করেছি।হ্যাঁ হ্যাঁ ,চেক করেছি...ওই নামের কোন পেশেন্ট বা ডেড বডি আমাদের হাসপাতালে আসেনি....না না কষ্ট কি..ইটস আওয়ার ডিউটি....
আবার ধপ করে সোফায় বসে পড়লেন মুমু।

টিউবলাইটের নিচে একটা টিকটিকির বাচ্চা লেজপাকিয়ে পোকা ধরতে যাচ্ছে। কোনায় একটা ক্ষুদেমাকড়সা ভয়ে ভয়ে একটা গান্ধির বাচ্চার দিকে এগুচ্ছে,আবার সরে আসছে। আপনমনে পাতাখাওয়া পোকাটা মানিপ্লান্টের ওপর বসে আছে।একাদশীর চাঁদটার ওপর একখন্ড পিচ্চিমেঘ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আবার সরে গেল। ক্রিস্টালের শো'পিসটা কাত হয়ে ছিল,অভ্যাস বসে মুমু ঠিক করে দিতে গেলেন...পরক্ষণেই মনে হলো...কি আশ্চর্য ! যার ছেলে ঘরে ফেরেনি সে কীনা...! আবার ফোনটা তুলে নিলেন........থানা। ফোন নম্বর জানা সব হাসপাতাল।পরিচিত আত্মিয়দের বাড়ি। মন্টুর বন্ধুদের বাড়ি।পুলিশ কন্ট্রোলরুম।সব শেষে আন্জুমান মফিদুল......! এসময়ই প্রথম মুমু ভেঙে পড়লেন। ইচ্ছে হলো হাউমাউ করে কাঁদেন। পারলেন না। কেন পারলেন না তার ব্যাখ্যা ও তার জানা নেই...........

টিক টিক করে দেওয়াল ঘড়িটা ঘুরে চলেছে। রাত তিনটা-সাড়েতিনটা-চারটা। লাইটের নিচের সেই শিকারকারীরা সরে গেছে। কুমড়োফালির মত চাঁদটা মাথার ওপর উঠে সরে গেছে। কয়েকটা বাদুড় দুলকিচালে উড়ে গেল। পুলিশের কিংবা এ্যাম্বুলেন্সের সাইরেণ আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল।
কেন বলতে পারবেন না,একটা অজানা আশংকা মাথায় এসে ধীরে ধীরে পুরো শরীরটা ছেয়ে দিল। শীত শীত করতে লাগল। আশংকাটা সত্যি ধরে মুমু র ভাবনা ফাস্টফরওয়ার্ড হতে লাগল...

কাল সকালে মন্টুর লাশ পাওয়া যাবে কোন এক ধানক্ষেতে,ভাঙ্গাচোরাভঙ্গিতে..পোস্টমর্টেম...দাফন..ফরর্মালিটিজ...মেয়েরা বলবে...'মা আমার বাড়ি চলো.'... মুমু যাবেন না..তারপর টিনশেড..তারও পরে...বস্তি.....মন্টু মাঝে মাঝে ওখানে যেত...হঠাত্ কি মনে করে মুমু ভাবলেন_খামোখাই তিনি অমঙ্গল চিন্তা করছেন! হয়ত দেখা যাবে সক্কাল বেলা মন্টু এসে চিত্কার জুড়ে দিয়েছে...মা জলদি খেতে দাও...ক্ষিদেয় নাড়িভুড়ি জ্বলে গেল....এই ভাবনাটা এত ঘন্টা পর মুমুকে একটু স্বস্তি দিল। মুমু সোফার উপরেই ঘুমিয়ে পড়লেন।

মুমু স্বপ্ন দেখছেন...মুমুর যেন পাখা গজিয়েছে...সেই দুই পাখার মাঝখানে মন্টুকে বসিয়ে মুমু উড়ে যাচ্ছেন.....শহর প্রান্তর শেষ করে আরো দূরে..নদী পেরিয়ে পাহাড় পেরিয়ে উড়ে যাচ্ছেন...মন্টু খিল খিল করে হহাসছে..খুব ছোট বেলায় মন্টু ওভাবে হাসত....মা ওই দেখ আর একটা নদী.....মুমু নদীটার কাছে এসে নিচু দিয়ে উড়লেন....ছোট ছোট ঢেউ ভেঙ্গে ভেঙ্গে যাচ্ছে.....হঠাত্ একটা বাজপাখি গোত্তাখেয়ে নেমে এলো মন্টু চিত্কার করে উঠল..মা !বাজপাখিটা ছোবল দিতেই মুমুর একটা ডানা ভেঙ্গে গেল..তিনি ভাঙ্গা ডানাটা দিয়ে বাজটাকে তাড়াচ্ছেন আর এক ডানা দিয়ে উড়ছেন প্রাণপণে....পিঠথেকে পিছলে পড়ে গেল মন্টু, তাকে ধরার জন্য দিকবিদিক হাত-পা ছুঁড়ছেন.....মন্টুর চিত্কার ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে....মা...মাগো...
হুড়মুড় করে উঠে বসলেন মুমু...মনে হলো দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে মন্টু ডাক দিল! দৌড়ে গেলেন! দরজা খুললেন যন্ত্রচালিতের মত। না। কেউ নেই।খুব ধীরে দরজা ঘেসে পড়ে গেলেন। জ্ঞান হারালেন মুমু।



লেখাটির বিষয়বস্তু(ট্যাগ/কি-ওয়ার্ড): সচেতন ভাবে ডেমনেস্ট্রেশনকরা থাকলেও ;
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জুন, ২০১০ বিকাল ৪:২৬


  • ২৫ টি মন্তব্য
  • ৫১৬ বার পঠিত,
Send to your friend Print
পোস্টটি ১১ জনের ভাল লেগেছে
২৯ শে আগস্ট, ২০০৮ রাত ১০:০৩
লেখক বলেছেন: শিরোধার্য
২. ২৯ শে আগস্ট, ২০০৮ রাত ১০:০৫
২৯ শে আগস্ট, ২০০৮ রাত ১০:১৬
লেখক বলেছেন: এটা শিরোধার্য না।
৩. ২৯ শে আগস্ট, ২০০৮ রাত ১০:০৫
২৯ শে আগস্ট, ২০০৮ রাত ১০:১৭
লেখক বলেছেন: আমরা এখন স্পেসম্যানের মত,অভিব্যক্তিহীন।
৪. ২৯ শে আগস্ট, ২০০৮ রাত ১০:১২
২৯ শে আগস্ট, ২০০৮ রাত ১০:১৮
লেখক বলেছেন: ধন্যবাদ শামীম।
২৯ শে আগস্ট, ২০০৮ রাত ১০:৩৪
লেখক বলেছেন: ধন্যবাদ ভাললাগার জন্য।
৬. ২৯ শে আগস্ট, ২০০৮ রাত ১০:৩৬
২৯ শে আগস্ট, ২০০৮ রাত ১০:৪০
লেখক বলেছেন: অগত্যা.............
৭. ২৯ শে আগস্ট, ২০০৮ রাত ১১:০৪
২৯ শে আগস্ট, ২০০৮ রাত ১১:৩৯
লেখক বলেছেন: চিকন ভাই সেলামালেকুম।মাইনাচ দিয়া ভালার্সেন।'তয় ভালা হইছে' তো কইছেন ! ধইন্যবাদ।
২৯ শে আগস্ট, ২০০৮ রাত ১১:৫১
লেখক বলেছেন: আপনার ভাললাগা ভাললাগল।
৯. ৩০ শে আগস্ট, ২০০৮ রাত ১:২১
ফারহান দাউদ বলেছেন: সবসময় মন্তব্য করাও ঝামেলা,ভাল লেগেছে বলতে বলতে সেটা একঘেয়ে হয়ে যায়। পড়েছি।
৩০ শে আগস্ট, ২০০৮ রাত ১:২৯
লেখক বলেছেন: আমারও সেই মত। ভাল থাকবেন।
১০. ০১ লা সেপ্টেম্বর, ২০০৮ রাত ১১:০৯
০৩ রা সেপ্টেম্বর, ২০০৯ ভোর ৪:৪৮
লেখক বলেছেন: সৌন্ধর্য্য
১২. ১৪ ই মার্চ, ২০০৯ সকাল ১০:৫৭
১৪ ই মার্চ, ২০০৯ বিকাল ৫:১৬
লেখক বলেছেন: যাচ্ছি। পড়ে আসি......
১৩. ০৩ রা সেপ্টেম্বর, ২০০৯ ভোর ৫:০৬
০৩ রা সেপ্টেম্বর, ২০০৯ ভোর ৬:১৩
লেখক বলেছেন:
দারুন একটা কমেন্টের উত্তর দিয়ে ঘুমাতে যাই......ঠিক একবছর আগের গল্পটা হঠাৎ সামনে চলে এলো......

মোট সময় লেগেছে ২.৫২০১ সেকেন্ড

কোন মন্তব্য নেই: