১২ ফেব, ২০১১

জেলখানার চিঠি (নাজিম হিকমত এর কবিতা) ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৮ রাত ১২:২৪


নাজিম হকিমত শুধু তুরষ্কের গত শতাব্দীর সব থকে প্রিয় কবিই নন,পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিদের মধ্যে একজন।বামপন্থীদের দলভুক্ত হয়ে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামের কারণে তাকে ২০ বছর সাজা ভোগ করতে হয়। সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার অপরাধে তাকে মোট ৫৬ বছরের সাজা দেওয়া হয়,যা তার নিজের বয়সের চয়েও বেশি।জন্ম ১৯০২ সাল। মাত্র ১৪ বছর বয়সে সাহিত্যে হাতে খড়ি।

এই কবিতাটি মূল র্তুকী থেকে ইংরেজিতে, পরে ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়।

অনুলিখন : লেখক।
কবিতাটি ফিউশন ফাইভ এর সংকলনের জন্য পোস্ট করা হলো।
---------------------------------------------------------------------------------


প্রিয়তমা আমার
তেমার শেষ চিঠিতে
তুমি লিখেছ ;
মাথা আমার ব্যথায় টন্ টন্ করছে
দিশেহারা আমার হৃদয়।

তুমি লিখেছ ;
যদি ওরা তেমাকে ফাঁসী দেয়
তেমাকে যদি হারাই
আমি বাঁচব না।

তুমি বেঁচে থাকবে প্রিয়তমা বধু আমার
আমার স্মৃতি কালো ধোঁয়ার মত হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে
তুমি বেঁচে থাকবে, আমার হৃদয়ের রক্তকেশী ভগিনী,
বিংশ শতাব্দীতে
মানুষের শোকের আয়ূ
বড় জোর এক বছর।

মৃত্যু......
দড়ির এক প্রান্তে দোদুল্যমান শবদেহ
আমার কাম্য নয় সেই মৃত্যু।
কিন্তু প্রিয়তমা আমার, তুমি জেনো
জল্লাদের লোমশ হাত
যদি আমার গলায়
ফাসীর দড়ি পরায়
নাজিমের নীল চোখে
ওরা বৃথাই খুঁজে ফিরবে
ভয়।

অন্তিম ঊষার অস্ফুট আলোয়
আমি দেখব আমার বন্ধুদের,তোমাকে দেখব
আমার সঙ্গে কবরে যাবে
শুধু আমার
এক অসমাপ্ত গানের বেদনা।


বধু আমার
তুমি আমার কোমলপ্রাণ মৌমাছি
চোখ তোমার মধুর চেয়েও মিষ্টি।
কেন তোমাকে আমি লিখতে গেলাম
ওরা আমাকে ফাঁসী দিতে চায়
বিচার সবে মাত্র শুরু হয়েছে
আর মানুষের মুন্ডুটা তো বোঁটার ফুল নয়
ইচ্ছে করলেই ছিঁড়ে নেবে ।

ও নিয়ে ভেবনা
ওসব বহু দূরের ভাবনা
হাতে যদি টাকা থাকে
আমার জন্যে কিনে পাঠিও গরম একটা পাজামা
পায়ে আমার বাত ধরেছে।
ভুলে যেও না
স্বামী যার জেলখানায়
তার মনে যেন সব সময় ফুর্তি থাকে

বাতাস আসে, বাতাস যায়
চেরির একই ডাল একই ঝড়ে
দুবার দোলে না।

গাছে গাছে পাখির কাকলি
পাখাগুলো উড়তে চায়।
জানলা বন্ধ:
টান মেরে খুলতে হবে।

আমি তোমাকে চাই ;তোমার মত রমনীয় হোক জীবন
আমার বন্ধু,আমার প্রিয়তমার মত........।

আমি জানি,দুঃখের ডালি
আজও উজাড় হয়নি
কিন্তু একদিন হবে।


নতজানু হয়ে আমি চেয়ে আছি মাটির দিকে
উজ্জল নীল ফুলের মঞ্জরিত শাখার দিকে আমি তাকিয়ে
তুমি যেন মৃন্ময়ী বসন্ত,আমার প্রিয়তমা
আমি তোমর দিকে তাকিয়ে।

মাটিতে পিঠ রেখে আমি দেখি আকাশকে
তুমি যেন মধুমাস,তুমি আকাশ
আমি তোমাকে দেখছি প্রিয়তমা।

রাত্রির অন্ধকারে,গ্রামদেশে শুকনো পাতায় আমি জ্বালিয়েছিলাম আগুন
আমি স্পর্শ করছি সেই আগুন
নক্ষত্রের নিচে জ্বালা অগ্নিকুন্ডের মত তুমি
আমার প্রিয়তমা, তোমাকে স্পর্শ করছি।

আমি আছি মানুষের মাঝখানে,ভালবাসি আমি মানুষকে
ভালবাসি আন্দোলন,
ভালবাসি চিন্তা করতে,
আমার সংগ্রামকে আমি ভালবাসি
আমার সংগ্রামের অন্তস্থলে মানুষের আসনে তুমি আসীন
প্রিয়তমা আমার আমি তোমাকে ভালবাসি।

রাত এখন ন’টা
ঘন্টা বেজে গেছে গুমটিতে
সেলের দরোজা তালা বন্ধ হবে এক্ষুনি।
এবার জেলখানায় একটু বেশি দিন কাঁটল
আট্টা বছর।

বেঁচে থাকায় অনেক আশা,প্রিয়তমা
তোমাকে ভালবাসার মতই একাগ্র বেঁচে থাকা।
কী মধুর কী আশায় রঙ্গীন তোমার স্মৃতি....।
কিন্তু আর আমি আশায় তুষ্ট নই,
আমি আর শুনতে চাই না গান।
আমার নিজের গান এবার আমি গাইব।

আমাদের ছেলেটা বিছানায় শয্যাগত
বাপ তার জেলখানায়
তোমার ভারাক্রান্ত মাথাটা ক্লান্ত হাতের ওপর এলানো
আমরা আর আমাদের এই পৃথিবী একই সুচ্যগ্রে দাঁড়িয়ে।
দুঃসময় থেকে সুসময়ে
মানুষ পৌঁছে দেবে মানুষকে
আমাদের ছেলেটা নিরাময় হয়ে উঠবে
তার বাপ খালাস পাবে জেল থেকে
তোমার সোনালী চোখে উপচে পড়বে হাসি
আমার আর আমাদের এই পৃথিবী একই সুচ্যগ্রে দাঁড়িয়ে !

যে সমুদ্র সব থেকে সুন্দর
তা আজও আমরা দেখিনি।
সব থেকে সুন্দর শিশু
আজও বেড়ে ওঠে নি
আমাদের সব থেকে সুন্দর দিনগুলো
আজও আমরা পাইনি।
মধুরতম যে-কথা আমি বলতে চাই।
সে কথা আজও আমি বলি নি।

কাল রাতে তোমাকে আমি স্বপ্ন দেখলাম
মাথা উঁচু করে
ধুসর চোখে তুমি আছো আমার দিকে তাকিয়ে
তোমার আদ্র ওষ্ঠাধর কম্পমান
কিন্তু তোমার কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম না।

কৃষ্ণপক্ষ রাত্রে কোথাও আনন্দ সংবাদের মত ঘড়ির টিক্ টিক্ আওয়াজ
বাতাসে গুন্ গুন্ করছে মহাকাল
আমার ক্যানারীর লাল খাঁচায়
গানের একটি কলি,
লাঙ্গল-চষা ভূঁইতে
মাটির বুক ফুঁড়ে উদগত অঙ্কুরের দুরন্ত কলরব
আর এক মহিমান্বিত জনতার বজ্রকণ্ঠে উচ্চারিত ন্যায্য অধিকার
তোমার আদ্র ওষ্ঠাধর কম্পু
কিন্তু তোমার কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম না।

আশাভঙ্গে অভিশাপ নিয়ে জেগে উঠলাম।
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বইতে মুখ রেখে।
অতগুলো কণ্ঠস্বরের মধ্যে
তোমার স্বরও কি আমি শুনতে পাই নি ?







লেখাটির বিষয়বস্তু(ট্যাগ/কি-ওয়ার্ড): কবিতা/কবিতা/ ;
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জুন, ২০১০ রাত ৩:১৪


  • ১৮ টি মন্তব্য
  • ৪০৬ বার পঠিত,
Send to your friend Print
পোস্টটি ৮ জনের ভাল লেগেছে
১. ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৮ রাত ১:৩৪
মনজুরুল হক বলেছেন: @ফিউশন ফাইভ । গতকাল কথা দিয়েছিলাম । এই কবিতাটা ইচ্ছে করলে আপনার পোস্টে নিতে পারেন।হয়তবা চর্বিতচর্বনই হয়ে গেল !
২. ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৮ রাত ২:১৭
ফিউশন ফাইভ বলেছেন: এককথায় অসাধারণ। নাজিম হিকমতের কবিতা পাঁচ পয়সার ফিউশন ফাইভ নেবে না- এটা কোনো কথা? পুরোটা ব্লগে তুলে দিয়ে আমার কষ্টটা কমিয়ে দিলেন। ধন্যবাদ।
৩. ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৮ রাত ২:১৮
দূরন্ত বলেছেন: অনেক আগে পড়েছিলাম। আপনার অনুলিখনের কল্যানে এটা আবার পড়ে খুব ভালো লাগলো।

বিংশ শতাব্দীতে
মানুষের শোকের আয়ূ
বড়জোর এক বছর.....


আমি আছি মানুষের মাঝখানে,ভালবাসি আমি মানুষকে
ভালবাসি আন্দোলন,
ভালবাসি চিন্তা করতে,
আমার সংগ্রামকে আমি ভালবাসি
আমার সংগ্রামের অন্তস্থলে মানুষের আসনে তুমি আসীন
প্রিয়তমা আমার আমি তোমাকে ভালবাসি।


বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক....
শুভেচ্ছা :)
১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৮ রাত ২:২৭
লেখক বলেছেন: বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক। আমাদের পেটি বুর্জোয়া সীমাবদ্ধতা কেটে যাক।

আপনাকেও শুভেচ্ছা।
৪. ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৮ রাত ২:২৪
মনজুরুল হক বলেছেন: পাঠকদের ভাল লাগলে তেলেঙ্গানা অঞ্চলের কিছু বিপ্লবি কবিতা আছে ইংরেজিতে অনুবাদ করা। সেগুলো বাংলা করে দেওয়া যায়। খুব সাদামাটা শব্দের ব্যবহারে রক্ত চনমন করে দেয়। একটু সময় করে দেব।সবার জন্য শুভকামনা।
৫. ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৮ রাত ২:২৮
১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৮ রাত ২:৩৬
লেখক বলেছেন: সত্যিকার অর্থে আমি কবিতাবোদ্ধা নই।কেউ কেউ অভিযোগ করেন আমার প্রবন্ধে বা কলামে নাকি কবিতার আবহ চলে আসে,অনেকটা গদ্য কবিতার মত ! আসলে আমি কবিতা খুবই কম পড়েছি ।ধন্যবাদ শামীম।

অ.ট. আমাদের দেখা হওয়া দরকার । আগামী কাল রাতে ম্যাসেন্জারে ফোন নাম্বার দিয়ে দেব। রাত ৩টা থেকে সাড়ে ৩টার মধ্যে।
৬. ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৮ রাত ২:৩৫
ফিউশন ফাইভ বলেছেন: বিপ্লবী কবিতা দেন, অসুবিধা নাই। কিন্তু নবারুণ ভট্টাচার্য, সুভাষ আর অমিয়বাবুর কবিতাগুলা একটু আগে দিয়েন।
১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৮ রাত ২:৩৬
লেখক বলেছেন: ঠিক আছে।
৭. ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৮ রাত ২:৫০
৮. ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৮ সকাল ১০:৫৫
নুশেরা বলেছেন: তেলেঙ্গানা অঞ্চলের কবিতার অপেক্ষায় রইলাম।
৩০ শে মে, ২০০৯ রাত ১২:০২
লেখক বলেছেন: বাংলা করা যে কি দুষ্কর... তাও চেষ্টা করছি, হয়ত কিছুদিন পরে দিতে পারব।
থ্যাংকস নুশেরা।
৯. ২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৮ রাত ৩:৫৬
আহসান হাবিব শিমুল বলেছেন: গুড জব।মুল তার্কিশ থেকে হইলে আরো ভালো হইতো হয়তোবা।আসলে ইংরেজি'র বাইরেও অন্যভাষা গুলো শেখা দরকার।

আরো কবিতার আশায় থাকলাম।
২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৮ ভোর ৪:২৩
লেখক বলেছেন: এমনিতেই জীবনের ফাঁকফোঁকোড়ে টেকনোলজি ঢুকে সরল সাদাসিদে জীবনের বারটা বাজিয়ে দিয়েছে,তার উপর আরো বিদেশী ভাষা ?

এর পর মালায়ালম,তামিল এর কন্নড় দেওয়ার চেষ্টা করব।
ধন্যবাদ।
৩০ শে মে, ২০০৯ রাত ১২:১১
লেখক বলেছেন:
সারা বিশ্বে মাত্র যে কয়জন কবির কবিতা পড়ি- ভালবাসি, নাজিম তাদের অন্যতম। মজার ব্যাপার হলো "পানকৌড়ির রক্ত", "জন্মই আমার আজন্ম পাপ", এগুলো পড়ার আগেই নাজিম পড়েছিলাম, এবং ফেঁসেছিলাম। আজো ফেঁসে আছি।
১১. ০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০১১ দুপুর ১:৩৬
রমিত বলেছেন: কবিতাটি চমৎকার। এর আরও কিছু অংশ আছে, পরবর্তিতে ছাপাবেন কি?
নাজিম হেকমত বামপন্থি ছিলেন। মস্কোতে তার জীবনাবসান হয়। সমাজতন্ত্রের পতন তিনি দেখে যাননি। জানিনা সেই পতন দেখলে তিনি ভিন্ন ধরনের কবিতা লিখতেন কিনা।
০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০১১ রাত ১১:৩৯
লেখক বলেছেন:
অনেক দিন আগের লেখায় আপনার মন্তব্য দেখে অনুপ্রাণীত হলাম। আশা রাখি পরের অংশটুকুও দিতে পারব।

এই ব্লগে আপনাকে স্বাগতম রমিত।

কোন মন্তব্য নেই: