১৭ ফেব, ২০১১

এন্টি গল্প > ক্রান্তিকালের মা >


০৮ ই অক্টোবর, ২০০৮ রাত ১১:৩৯

উত্তরে রাঢ় দক্ষিণে গাঙ্গেয় সমুদ্র, পশ্চিমে মগধরাজ্য পূর্বে আরাকানি। রাজ্যের দক্ষিণাঞ্চলে সেনরা শাসন করিতেছিল। মা গঙ্গা তাহার শাখা-প্রশাখা লইয়া গাঙ্গেয় সমুদ্রে পতিত হইবার কালে ভাটি অঞ্চল পলি-বিধৌত করিয়া বঙ্গালদিগের শশ্যাদি বৃদ্ধিতে প্রভুত সহায়তা করিতে ছিল। মহারাজা কৈবর্ত সেনের রাজত্বে চারিদিকে কেবলই সুবাতাস বহিতে ছিল। প্রজারা মাটি কর্ষণ করিয়া সকলের ক্ষুন্নিবৃত্তির উপায় করিতে ছিল। তাহাদের কাহারো মধ্যে জগতসংসারের যতরূপ ব্যথা কষ্ট রহিয়াছে তাহার কিছুই স্পর্শ করিতেছিল না। রাজ দরবারের নিয়ম মাফিক সভায় সভ্যগণ রাজাকে এই মর্মে জ্ঞাত করাইতেছিলেন যে সমগ্র রাজ্য জুড়িয়াই অপার শান্তি বিরাজ করিতেছে। এইরূপ অতিশয় সুখ ব্যঞ্জক সন্দেশপ্রাপ্তিতে রাজা ইচ্ছা প্রকাশ করিলেন তাহা হইলে আগামী শীত মৌসুমে পাখি শিকারের ব্যবস্থা হইলে কী রূপ হয়? যথার্থ, তথাস্থ বলিয়া সভাসদগণ উৎফুল্ল হইয়া গম গম শব্দযোগে রাজপ্রসাদ কাঁপাইয়া তুলিল।

শীত আসিবার কালে রাজা জ্ঞাত হইলেন ত্রিপাঠিনগরের উপকন্ঠে পাখি শিকারের যে স্থান নির্বাচন করা হইয়াছিল তাহাতে কতিপয় স্বজাতি জবন এবং মগধদিগের প্ররোচনায় বিদ্রোহ করিতেছে। সৈন্যসামন্ত পেয়াদারা ভূমি দখল লইতে পারে নাই। উনাশিজন স্বজাতি, মগধ এবং জবনকে হত্যা করিবার পরও শীর্ণদেহ শুদ্র আর চন্ডালদিগের শরীরে কোথা হইতে এইরূপ দ্রোহ বাসা বাঁধিল তাহাই রাজাকে ভাবাইয়া তুলিল। রাজা ভাবিলেন। সভাসদ আর আমর্ত্যরা ভাবিলেন। সিদ্ধান্ত হইল সেন বংশের মর্যাদা রক্ষার্থে প্রজাকুলে শান্তি রক্ষার্থে আর সভাসদ আমর্ত্যবর্গের নিরাপত্তা নিশ্চিন্ত করিতে বিদ্রোহ দমন করিতে হইবে। এগারশত সৈন্য লইয়া সেনাপতি অকুস্থলে গমন করিলেন। আঠার দিন পর রাজাকে এইরূপ সন্দেশ উপস্থাপন করা হইল।

"আড়াইশত চাষা, চন্ডাল-শুদ্রকে কয়েদ করা হইয়াছে। একশত উনিশখানা কুঁড়ে এবং চারচালা ভূপাতিত করা হইয়াছে। নিহতদের মধ্যে প্রায় দেড় কুড়ি শিশু ও নারী রহিয়াছে। তাহাদের ভিতরও বিদ্রোহ সংক্রমিত হইয়াছিল কী- না তাহা ঠাওর করা যায় নাই।"

রাজা কহিলেন ঠাওরে কাজ নাই, কহিতে থাকো। অতঃপর মাথা নিচু করিয়া সংবাদে উপস্থাক কহিলেন ' কিন্তু মহারাজ রাহুল নাম্নিয় বিদ্রোহের প্রধান হোতা পালাইতে সক্ষম হইয়াছে।' রাজা বামহস্ত উত্তোলন করিয়া বিরক্তি প্রকাশ করিলেন। বিরক্তি! পরদিন হইতে রাজ্যময় একটিই আলোচ্য বিষয় রাজার বিরক্তি! শত সহস্র সভাসদ, সুশীলজন, ব্রাহ্মণ-কায়েত, পুরুত. মুনি-ঋষীগণ ব্যাকুল হইলেন। রাজা বিরক্ত হইয়াছেন? এ যে ভাবনার ও অতীত? পরের সারাটা বছর জুড়িয়া রাজার পেয়াদারা রাহুলকে খুঁজিয়া বেড়াইতে লাগিল। রাজার এই মহাবিরোক্তিতে একাত্মতা প্রকাশ করিবার জন্য পুন্ড্রদের রাজা, উক্তর খন্ডের রাজা এমনকি কামাখ্যা প্রদেশের রাজারাও সাহায্যের হস্ত বাড়াইয়া দিলেন। বছরাধিকাল পরে। রাজার হুকুমে বিদ্রোহী রাহুলের মাতা সরুজুবালা দেবীকে আটক করিয়া রাজ দরবারে হাজির করা হইল।

”তোমার পুত্রকে কোথায় রাখিয়াছ? রাজা জানিতে চাহেন।
”জানিনা, জানিলেও বলিতাম না।”
”মহারাজ ঔদ্ধত্য দেখিলেন? তুমি কি জান না তাহাকে খুঁজিয়া বাহির করা হইবেএবং রাজআদেশ অমান্য করিবার অপরাধে কতল করা হইবে?”
”জানি। কতলে কী বা আসে যায়। আমার পুত্র অন্যায় করে নাই। করিতে পারে না। তাহাকে আমি মনুষ্যজগতের সর্বাপেক্ষা ভাল শিক্ষা দিয়াছি”
”কী সেই শিক্ষা শুনি? রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ?”
”ঠিক তাই। তাহাকে আমি মানুষের সেবা করিতে শিখাইয়াছি। আপনারা দু’চারিদানা খাদ্য ছড়াইয়া জনকল্যাণ করিতে চাহেন। আমার পুত্র প্রজা দিগকে শিখাইতেছে যে, রাজ্যের সকল কিছুই তাহাদের, রাজার নহে, রাজা আবারো বিরক্ত হইলেন। এইবার সিংহাসন কাঁপাইয়া হুংকার ছাঁড়িলেন, ”আমার সম্মুখ হইতে এই কুলটাকে লইয়া যাও, আর পুর্ণীমা কাটিয়া অমবশ্যা আসিবার আগেই তাহারপুত্রের কাটা মুন্ডু দেখিতে চাই। সেই বন্দোবস্ত কর।”

ইরাবতীর জল গড়াইয়া সমুদ্রে পড়িল। পাখিরা আবার উত্তরে উড়িয়া গেল। শশ্য ক্ষেতের চারা বড় হইয়া পাকিল। ফসল উঠিয়া রাজার গোলা ভরিল। প্রজাকুলের শীর্ণ মুখগুলি অধিকমাত্রায় শীর্ণ হইল। রাজানুকুল্লের রাজেন্যবর্গরা ভাবিত হইলেন্, রাজাকে প্রীত করিবার যথাসাধ্য কসরত করিলেন। রাজা নিয়মিত সৈন্যদের উপর আস্থা রাখিতে না পারিয়া বিশেষ বাহিনী গঠন করিলেন। তাহারা বিষমাখা তীর, তরবারী, ল্যাজা লইয়া স্বর্গমর্ত্য চষিয়া বেড়াইতে লাগিল।

বর্ষা আসিয়া চলিয়া যাইবার প্রাক্কালে এক অপরাহ্নে সকলে দেখিল শ্বেত শুভ্র বস্ত্রে এক বৃদ্ধা কিংশুক তলে একটি মনুষ্য দেহ কোলে লইয়া স্থির বসিয়া রহিয়াছেন। শুধুই মনুষ্য দেহ। মুন্ডু নাই। অশরীরী আতংকে কেহ ধারে যাইতে চাহিল না। গভীর রাতে শেয়াল হায়নারা আসিয়া ঘিরিয়া দাঁড়াইল। বুঝিবা মুন্ডুহীন শব তাহাদের ক্ষুধাকে ভুলাইয়া থাকিবে। কেহ আক্রামণ করিল না। প্রত্যুষে যখন রক্তবর্ণের থালার মত সূর্য্য উঠিল, তখন সকলে দেখিল বামুনের সন্তান চিতাগ্নির বদলে মাটিচাপা হইয়াছে। বৃদ্ধা সরুজুবালা নিজেই মাটিচাপা দিয়া মুঠো মুঠো মাটি কিংশুক তলে ছড়াইতেছে। ইহার কোনো কারণ কেহই খুঁজিয়া পাইল না।

১৪শ’ বছর পর। বর্ষাকালের এক সন্ধ্যা। এক বৃদ্ধা কাটা শিমুলগাছতলে বসে আছেন। গাছটা ক’দিন আগেই কাটা হয়েছে। এরই মধ্যে কাটা গুড়িতে নতুন পাতা-কুড়ি বেরুতে শুরু করেছে। সরুজুবালা দেবী যে কিংশুকতলে (শিমুল) বসেছিলেন। এটা কি সেই? শিমুলের ফুল রক্ত লাল। রাহুলের রক্ত লাল। এই বৃদ্ধার সন্তানের রক্ত লাল। শিমুলের ফল পেকে তুলো হয়ে আকাশে ওড়ে, সাথে একটি করে বীজ বয়ে চলে। সহস্র মাইল দূরে যেয়ে গাছ হয়। এটা কি সেই গাছ? বীজ কি উড়ছেই। বৃদ্ধার নাম কি নভেরা?

লেখাটির বিষয়বস্তু(ট্যাগ/কি-ওয়ার্ড): নভেরা ;
প্রকাশ করা হয়েছে: এন্টি গল্প  বিভাগে । সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জুন, ২০১০ রাত ৩:২৮


  • ২৭ টি মন্তব্য
  • ২৭৯ বার পঠিত,
Send to your friend Print
পোস্টটি ৭ জনের ভাল লেগেছে
১. ০৮ ই অক্টোবর, ২০০৮ রাত ১১:৪৩
০৮ ই অক্টোবর, ২০০৮ রাত ১১:৪৫
লেখক বলেছেন: না।
২. ০৮ ই অক্টোবর, ২০০৮ রাত ১১:৪৭
০৮ ই অক্টোবর, ২০০৮ রাত ১১:৫০
লেখক বলেছেন: দ্যাটস হিট।
৩. ০৮ ই অক্টোবর, ২০০৮ রাত ১১:৫৩
রাতমজুর বলেছেন: পারিবারিক কম্যুনিষ্ট ব্যাকগ্রাউন্ডের কারনে ভেতরে কম্যুনিজম খুব কাজ করে, তবে ওদের অনেক নীতিই মানতে পারি না এখন আর। পুরোনো নীতিগুলোর মডিফিকেশন দরকার।
০৯ ই অক্টোবর, ২০০৮ রাত ১২:০৫
লেখক বলেছেন: বলপ্রয়োগে সর্বহারা শ্রেণী কর্তৃক ক্ষমতা দখল আর প্রচলিত নির্বাচনী পন্থায় ক্ষমতারোহনের মধ্যে কিছু মৌলিক পার্থক্য থাকবেই।হ্যাঁ মোডিফিকেশন দরকার।
৪. ০৮ ই অক্টোবর, ২০০৮ রাত ১১:৫৬
০৯ ই অক্টোবর, ২০০৮ রাত ১২:০৬
লেখক বলেছেন: এটাকে স্রেফ গল্প হিসেবেই দেখুন না....
৫. ০৯ ই অক্টোবর, ২০০৮ রাত ১২:১৬
০৯ ই অক্টোবর, ২০০৮ রাত ১২:৫১
লেখক বলেছেন: ক'দিন কোথায় ডুব দিয়েছিলেন শামীম ?
০৯ ই অক্টোবর, ২০০৮ রাত ২:১৩
লেখক বলেছেন: আমি ভাবলাম অভিমান করে বুঝি ব্লগই ছেড়ে গেলেন ! ভাল থাকুন। বেশ অনেক দিন আপনার মৌলিক কিছু আসছে না। ঝটপট কিছু লিখে ফেলুন।
৭. ০৯ ই অক্টোবর, ২০০৮ রাত ১:১৭
০৯ ই অক্টোবর, ২০০৮ রাত ২:১৫
লেখক বলেছেন: বোধহয় তা-ই ছিল।ধন্যবাদ।
৮. ০৯ ই অক্টোবর, ২০০৮ ভোর ৬:০৭
মিঞা ভাই বলেছেন: জনমানুষের মুক্তি চাই এই শোষনের সমাজ থেকে। আপনার স্বপ্নটার জন্য ধন্যবাদ।
১১ ই অক্টোবর, ২০০৮ রাত ২:০৭
লেখক বলেছেন: আমরা নিরাপদ বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি...................
৯. ০৯ ই অক্টোবর, ২০০৮ ভোর ৬:৫২
নুশেরা বলেছেন: একান্ত ব্যক্তিগত মত: শেষ প‌্যারাটির কারণে গল্পের অবিচ্ছিন্ন অসাধারণ আমেজটা কেটে গেছে; উপসংহারটুকু না থাকলেও কালান্তরের সাদৃশ্য খুঁজে পেত পাঠক। হয়তো এটা এন্টি-গল্প, তাই এর প্রয়োজন ছিল লেখকের কাছে।
০৯ ই অক্টোবর, ২০০৮ সকাল ৭:০২
লেখক বলেছেন: টানা ১১ ঘন্টা ব্লগে। কাল (আজ) ছুটি। এখন আর লিখতে ভাল্লাগছে না।
পরে বলব.........শুভ সকাল।
১০. ০৯ ই অক্টোবর, ২০০৮ দুপুর ১:৩৮
ফারহান দাউদ বলেছেন: পড়লাম,মানলাম না,যাকগে,সব কথায় একমত হওয়া লাগবে এমন না।
০৯ ই অক্টোবর, ২০০৮ রাত ৯:২৩
লেখক বলেছেন: "যাকগে,সব কথায় একমত হওয়া লাগবে এমন না।"

গণতন্ত্র বলি আর পরমত সহিষ্ণুতাই বলি তা এটা....মন্তব্যে ধন্যবাদ।
০৯ ই অক্টোবর, ২০০৮ রাত ৯:২৫
লেখক বলেছেন: কৈবর্তকালের ভাষা আর প্রমিত ভাষা নিয়ে একটা সমালোচনা আশা করেছিলাম ; কেউ করল না!
১২. ১১ ই অক্টোবর, ২০০৮ রাত ১২:৩৭
তারার হাসি বলেছেন: আমরা আজও তাই করে যাচ্ছি, দুই চার কণা খাদ্য ছড়াইয়া জনকল্যাণ করতে চাই, আর বিশেষ বাহিনী, বিশেষ তদন্ত টিম, বিশেষ কমিটি... মজাই লাগে...
কতশত মায়ের আহাজারি চারিদিকে, আমরা আজকাল দেখতেও পাই না।
১৩. ১১ ই অক্টোবর, ২০০৮ রাত ২:৪৯
মনজুরুল হক বলেছেন: আমাদের মায়েরা শুধু ৩০ লাখ সন্তানকেই হারায়নি, সেই থেকে ক্রমাগত প্রসবযন্ত্রণার চেয়েও মারাত্মক যন্ত্রণা সয়ে চলেছে.....এরা হলো সেই 'হাজার চুরাশীর মা'।

মাঝে মাঝে সব কিছু খুব অর্থহীন মনে হয় !
১৪. ২১ শে অক্টোবর, ২০০৮ সকাল ১১:৫৪
যীশূ বলেছেন: দারুন চলছিলো। শেষটা অন্যরকম হলে আরও সুন্দর লাগতো বোধহয়।
২১ শে অক্টোবর, ২০০৮ বিকাল ৩:৪২
লেখক বলেছেন: অন্যরকম হয় না যীশূ ! এইরকমই নির্মমতা সহনীয় হচ্ছে আমাদের।
১৫. ২৮ শে জুলাই, ২০০৯ দুপুর ১২:১২ অপ্‌সরা বলেছেন: একজন মা নভেরার কথা জানলাম ভাইয়া।

শেষটাই অনেক কষ্টের তবুও লেখাটা অসাধারণ তবে আমার বোঝার মতও ।

কোন মন্তব্য নেই: