১৬ মার্চ, ২০১১

এন্টি গল্প > সেই এক বৃষ্টিদিনে >



২৮ শে অক্টোবর, ২০০৮ রাত ১১:৩৯

অলস একঘেয়ে ভাবে বৃষ্টি ঝরছিল । দাঁড়িয়ে ছিলাম একটা আলসের নিচে । যাব রাস্তার ওপারে । পরিচিত ওষুধের দোকানে। সম্ভবত প্যারাসিটামল জাতীয় কিছু একটা কিনব বলে ঠিক কিছিলাম, কিন্তু ঘ্যানঘেনে বৃষ্টির জন্য বিরক্তি । পা বেয়ে একটা কেঁচো উঠে আসতে চেয়ে কি মনে করে আবার নেমে গেল। শরীরটা লম্বা করে দিয়ে আবার গুটিয়ে নিয়ে ওটার অন্যত্র গমন।ওর সাথের কেঁচোটা জমে ওঠা জলে খাবি খাচ্ছে। একটা জবজবে ভেজা মুরগি ঠোকর মারার ধান্ধায় আছে। ভেসে যাওয়া চিপসের খোসার ওপর এদল ডাঁই পিপড়ে মহা সুখে জলভ্রমণ করছে.....।ঠিক এই সময় রাস্তা পেরুলাম.....।

"কি ভাই ভাল তো? পঁচায়ে দিল..,গা দেখি ভিজ্জ্যা গেছে...,আইজকা ইলিশ আর খিচুঁড়ি জমবো ভাল...,ইলিশের যা দাম....ছোঁয়াই যায় না....,হূহ সেদিন আর নাই.........'এই অনাবশ্যক কথাগুলো আমাকে উদ্দেশ্য করে বলা হচ্ছিল সেটা বুঝিনি, কারণ আমার চোখ তখন রাস্তার উল্টো দিকে। মাঝ বয়সী একটা লোক কিশোরী মেয়েটাকে হিড় হিড় করে টেনে রাস্তা পার করে ওষুধের দোকানে এসে দাঁড়াল।

"ব্যাথার ওষুধ আছে?"।
'আপনার কিসের ব্যাথা?'
আমার না, মুখ বাঁকিয়ে মেয়েটাকে দেখাল।
আমি জিজ্ঞেস করি...'কি হয়েছে ওর'।
'আমি মারছি'। নির্লিপ্ত উত্তর।
এর পর কি বলা উচিত সেটা বুঝতে না পেরে নির্বাক থাকলাম আমি,দোকানি এবং আরো দু'চার জন।
লোকটাকে দোকানদার কি একটা ট্যাবলেট দিল। পয়সা মিটিয়ে লোকটা আসা'র ভঙ্গিতেই চলে গেল।

বাড়ি ফিরে আমার মনে হলো ঠিক এই রকম গরিব মানুষদের কম কথা কখনো শুনেছি?উত্তর-না। লোকটা সম্ভবত....সম্ভবত কেন ,সত্যিই সে মেয়েটার বাপ । একটা বাপ তার মেয়েকে নিজে মেরে আবার তার জন্য ওষুধ কিনতে এছসছে......। নিজেকে রাম পাঁঠা মনে হলো। নিশ্চই আমার জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল ...কেন লোকটা তার মেয়েকে মেরেছিল.....।

বাইরে বৃষ্টিটা বেড়েছে। শহূরে মানুষের বৃষ্টিকালিন ভাবনা পাখা মেলেছিল আগেই।সেই সুখদায়ক ভাবনার ফাঁকফোকোড় গলে আরো একটা ভাবনা ঢুকবো ঢুকবো করছিল.....এই বৃষ্টিতে ফুটপাথে-বস্তিতে ঝুঁপড়িতে থাকা মানুষগুলোর কষ্টের ভাবনা....। এ পর ধারাবাহিক ভাবে প্রোভারটি,স্টেট,প্রোলেতারিয়েত...অনঢ় পাথর...।মধ্যবিত্তের এমনই হয়।কুলকিনারাহীন ভাবনা নিজের পাথেয় সুখটাকে' হেল' করার মূহুর্তে সে রণে ভঙ্গ দেয়।এভাবেই সে চলমান সুখের চাদর তলে সেঁদিয়ে আগামীর জন্য বাঁচে।

গভীর ঘুমে তলানোর আগে স্থির করেছিলাম লোকটাকে খুঁজব।এত বড় শহরে একটা মুহূর্তদেখা মানুষকে খুঁজব? কথাটা মনে করে নিজেকে পাঁঠা নয় আবাল মনে হলো।
এর পর সময় সময়ের ঢঙেই পেছনে চলে গেছে। আমার সহৃদয় মধ্যবিত্তভাবনা জল- সার- মাটি না পেয়ে আর অংকুরিত হয়নি।এর পরেও বৃষ্টি হয়েছে,কেঁচোরা পায়ে উঠতে চেয়েছে,অন্য কেঁচোরা জলে খাবি খেয়েছে,চিপসের খোসায় ডাঁই পিঁপড়েগুলো জলভ্রমণ করেছে......ওই লোকটি আর তার মেয়ে ফ্রেমে আসেনি।

একদিন বাসে উঠব বলে দাঁড়িয়ে আছি,হঠাৎ দেখি সেই লোকটা ! বুকের কাছে একটা বাটি চেপে ধরে হেঁটে যাচ্ছে...........। এবার আর ভুল হলো না।লোকটার পিছু নিলাম।পাঁচিলের ওপর থেকে পলিথিন ত্যারসা হয়ে ফুটপাথে মিশেছে,তার ওপর গোটা কতক ইঁট দেওয়া।লোকটা ওখানে এসে বসে পড়ল।আমি পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।
'ক্যামন আছেন,আমাকে চিনতে পেরেছেন?'
'জ্বে না'। আবার সেই নির্লিপ্ত উত্তর।
'ওই যে একদিন ওষুধের দোকানে'......মুখটা নামিয়ে নিল সে। বাটিটা পলিথিনের ভেতর দিয়ে আমার দিকে তাকাতেই জিজ্ঞেস করলাম...
'আচ্ছা আপনি মেয়েটাকে মেরেছিলেন কেন,ওতো আপনারই মেয়ে...না?
'হ'।
'তাহলে?'
লোকটা খানিকক্ষণ ঘোলাটে চোখে আমাকে দেখে যা বলল তা শোনার জন্য এই আমি নেক্রোপলিস আরবানাইজড হোমো স্যাপিয়েন্স প্রস্তুত ছিলামনা।
....'হেইদিন ঘরে খাওন আছিল না,ওরে কইলাম কাষ্টমার আইছে , বহা। হুনলনা । কাষ্টমারের গা-গতর দেইখ্যা ডরাইল, মিছা কথা কইল...শরিল খারাপ, মেজাজ চইড়া গেল,দিলাম কিল। মনে অয় জোরে দিয়া বইছি। অহনো জ্বর যায় নাই মেয়াডার। '

আমার বনেদি কালচারাল প্রোফাইলে কদর্য রূঢ় বাস্তবতা নেই বলে মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম 'কাষ্টমার...ডর...কি বলছেন?''
'বোঝেন নাই সার?'আমরা বেশ্যা। অর মা ও আছিল বেশ্যা। অর বিয়া অইলে প্যাটে যেইডা অইব হে ও বেশ্যা অইব.............."

আমার মাথার ভিতর এক সাথে অনেক গুলো টায়ার ব্রাস্ট করল ,লোকটার পিতৃস্নেহ,ক্ষুধা নিবারণের পরাবাস্তব,কচি মেয়েটার ভয়ার্ত মুখ ,আদিমতা সব ঘোট পাকিয়ে প্রবল বেগে ছুটোছুটি করতে লাগল মাথা পেট বুক জুড়ে , এক সময় পেট থেকে কি যেন দলা পাকিয়ে গলার কাছে উঠে এলো....স্বাদটা টক টক, মনে হলো বমি হবে , হলো না ।




লেখাটির বিষয়বস্তু(ট্যাগ/কি-ওয়ার্ড): আনআরবান ;
প্রকাশ করা হয়েছে: এন্টি গল্প  বিভাগে । সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জুন, ২০১০ রাত ৩:৪৭



  • ১২ টি মন্তব্য
  • ২২৩ বার পঠিত,
পোস্টটি ৬ জনের ভাল লেগেছে
২৯ শে অক্টোবর, ২০০৮ রাত ১২:২৪
লেখক বলেছেন: হুমম


২. ২৯ শে অক্টোবর, ২০০৮ রাত ১২:০৩
তারার হাসি বলেছেন:
কোন কোন জীব আছে
আজীবন আলো চায়
বহুকাল বেঁচে থেকে অবশেষে
একদিন নিভে যায়।


২৯ শে অক্টোবর, ২০০৮ রাত ১২:১১
লেখক বলেছেন: বুঝতে ব্যর্থ হলাম।
একটু ব্যাখ্যা করবেন প্লিজ ?


৩. ২৯ শে অক্টোবর, ২০০৮ রাত ১২:৩৮
তারার হাসি বলেছেন: আমি আর ব্যাখ্যা ! হয়তো বুঝতেই পারি নাই আপনার বক্তব্য............

"আমরা বেশ্যা। অর মা ও আছিল বেশ্যা। অর বিয়া অইলে প্যাটে যেইডা অইব হে ও বেশ্যা অইব.............."

এই মা মেয়ের কথা ভেবেই লিখেছি এমন, সাধারণ মানুষের মত তারাও চেয়েছে সাধারণ জীবন কিংবা হয়ত কোনদিনই কিছু চায় নাই!
জানে ...... কিছু নেই তাদের জন্য।

২৯ শে অক্টোবর, ২০০৮ রাত ১২:৪৭
লেখক বলেছেন:

আপনার মনটা অনেক বড় । সংস্কারমুক্ত।

আমি অসম্ভব সুন্দরের ভেতরও কষ্ট দেখতে পাই বলে কখনো 'সুন্দর' দেখে উচ্ছ্বসিত হতে পারি না..........

এই রকমই এক কষ্ট পেয়েছিলাম দার্জিলিংয়ে............
আপনার 'টাইগার হিল' পোস্টে আছে।


২৯ শে অক্টোবর, ২০০৮ রাত ২:৫৯
লেখক বলেছেন: হা হা হা ! ফারহান পোস্টে হুম, না কমেন্টে হুম ?


৫. ২৯ শে অক্টোবর, ২০০৮ রাত ৯:৩০
নিবিড় বলেছেন: চমৎকার লিখেছেন.....প্রথমে পড়তে খুব ভাল লাগছিল সুন্দর বর্ণনা গুলি চোখে ভাসছিল ....কিন্তু পরে মনে একটা অজানা ফিলিংস কাজ করল..।


পৃ্থিবীটা এমনই ....এক দিকে প্রকৃ্তির শোভা আর অন্যদিকে প্রাকৃ্তিক নিয়মের পরিহাসের কাছে মানুষের পরাজয়।

০২ রা নভেম্বর, ২০০৮ বিকাল ৪:৩০
লেখক বলেছেন: ধন্যবাদ নিবিড়। ঘন ঘন প্রফাইল ফটো চেন্জ করে চপল বালিকা সুলভ
ইস্ততত বিক্ষিপ্ত ছুটোছুটি করেন বটে, তবে আপনি লেখা বোঝেন, লিখতে পারেন সেটা আগেও বলেছি......তার পরও দেখি কস্টলি টাইম ওয়েস্টেজ করেন..............

আপনাকে বললাম- টেক্সাসের ট্রেইল নিয়ে লিখুন। কই ?


৬. ৩১ শে অক্টোবর, ২০০৮ সন্ধ্যা ৭:২৪
বিষাক্ত মানুষ বলেছেন: আপনার লেখা ধীরে ধীরে পড়তে হয় .. তাড়াহুড়োয় কিছু বোঝা যায় না
অবশ্য ধীরে পড়েও যে সব বুঝেছি সেটাও বলা যাচ্ছে না

০২ রা নভেম্বর, ২০০৮ বিকাল ৪:৩৫ লেখক বলেছেন: "বাইরে বৃষ্টিটা বেড়েছে। শহূরে মানুষের বৃষ্টিকালিন ভাবনা পাখা মেলেছিল আগেই।সেই সুখদায়ক ভাবনার ফাঁকফোকোড় গলে আরো একটা ভাবনা ঢুকবো ঢুকবো করছিল.....এই বৃষ্টিতে ফুটপাথে-বস্তিতে ঝুঁপড়িতে থাকা মানুষগুলোর কষ্টের ভাবনা....। এ পর ধারাবাহিক ভাবে প্রোভারটি,স্টেট,প্রোলেতারিয়েত...অনঢ় পাথর...।মধ্যবিত্তের এমনই হয়।কুলকিনারাহীন ভাবনা নিজের পাথেয় সুখটাকে' হেল' করার মূহুর্তে সে রণে ভঙ্গ দেয়।এভাবেই সে চলমান সুখের চাদর তলে সেঁদিয়ে আগামীর জন্য বাঁচে।"

"আমার মাথার ভিতর এক সাথে অনেক গুলো টায়ার ব্রাস্ট করল ,লোকটার পিতৃস্নেহ,ক্ষুধা নিবারণের পরাবাস্তব,কচি মেয়েটার ভয়ার্ত মুখ ,আদিমতা সব ঘোট পাকিয়ে প্রবল বেগে ছুটোছুটি করতে লাগল মাথা পেট বুক জুড়ে , এক সময় পেট থেকে কি যেন দলা পাকিয়ে গলার কাছে উঠে এলো....স্বাদটা টক টক, মনে হলো বমি হবে , হলো না ।"
-----------------------------------------------------------------------------

এ অধ্যায় দুটি আমার প্রিয় শব্দচয়ন। আমি হতাশ এবিষয়ে কেউ খুঁতও ধরল না,ভালও বলল না !!

কোন মন্তব্য নেই: